Friday 3 December 2021

কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||

শ্রাবণী গুপ্ত-র বই 'সমান্তরাল দুটি গাছ'-কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করলেন বিশ্বরূপ দাস।



সাহিত্য সাধিকা- শ্রাবণী গুপ্ত
কলমে - বিশ্বরূপ দাস

যে কোন কবি বা লেখকের সাহিত্যকীর্তির মধ্যেই ফুটে ওঠে তাঁর মন, মানসিকতা এবং চিন্তাভাবনার মৌলিকতা। সাহিত্য দর্পণ-এ প্রতিভাত হয় তাঁর জীবন দর্শন।সৃষ্টির মধ্যেই ফুটে ওঠে কৃষ্টির ফুল। তার সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে তামাম পাঠককুলের মধ্যে। আসলে এই কবি সাহিত্যিকরা হয়ে ওঠেন জীবনী শিল্পী। তাই তাঁদের কথার অক্ষরে গাঁথা পরে প্রকৃতি -মানুষ -ধর্ম -বিজ্ঞান -ইতিহাস -পুরাণ থেকে শুরু করে পার্থিব ও অপার্থিব জগতের নানান কথকথা। কখনো রূপকের ঠাস বুননে,কখনো অলংকারের চাতুর্যে, ছন্দের মাধুর্যে এবং মোহিনী কল্পনায় তাঁরা আমাদের উপহার দেন এক অপূর্ব সুন্দর নান্দনিক জগতকে।

সেইসব শিল্পীদের মধ্যে আমি আজ যার কথা বলব তিনি হলেন আধুনিক কবি শ্রাবণী গুপ্ত। 1980 সালে 18 জুলাই  পিতা রুপলাল গুপ্ত এবং মা শিবানী গুপ্তের কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করে ছোট্ট শ্রাবণী। ছোট থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে শিক্ষিকা হবেন। হবেন মানুষ গড়ার কারিগর। বিশ্ব বিধাতা তাঁর সেই মনের কথা বোধহয় স্বকর্ণে শুনেছিলেন। তাই জন্মস্থান কাটোয়ায় মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া শেষ করে বর্ধমান শহর। তারপর রাণীগঞ্জ টি ডি বি কলেজ থেকে স্নাতক ও ছত্রপতি শাহুজি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। সংসার সন্তান সামলাতে সামলাতেই স্কুল সার্ভিস পরীক্ষায় নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে প্রবেশ করেন কর্মজীবনে। এরই মাঝে তাঁর সৃজনশীল মন প্রকৃতি ও মানুষকে ভালোবেসে দীপাবলীর সন্ধ্যার মতো মনের গহীনে কতবার আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলতে চেয়েছে মনের কথা।কিন্তু তা প্রকাশের রাস্তা পাচ্ছিল না। শিকড়ের দু-একটা পালক ঘাসের শিশিরে ক্রমশ ভারী হয়ে আসছিল।তারপর হঠাৎ একদিন এসে গেল সেই শুভ লগ্ন। ভাব সিন্ধুর পারে বেজে উঠলো রাখালিয়া বাঁশির সুর। স্বয়ং বাগদেবী  যেন তার অদৃশ্য শিলালিপি আর তানপুরা উপহার দেবো বলে অপেক্ষায় ছিলেন। সেই অপেক্ষার দিনটি এলো 2016 সালে । পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় তখন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়েছে কন্যাশ্রী প্রকল্প। বিভিন্ন বিদ্যালয়ে মহাসমারোহে পালিত হচ্ছে কন্যাশ্রী দিবস। সেই দিবসটিকে বর্ণে গন্ধে স্মরণীয় করে রাখার জন্য  ছাত্রীদের অনুরোধে তাঁর প্রথম লিখতে আসা। নতুন কিছু করার বাসনায় সেই সময়ই তিনি আপন মনের গোপনে মাধুরী দিয়ে  লিখে ফেলেন বেশ কয়েকটি গান ও কবিতা। তারপর থেকে তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। কারণ তাঁর ইচ্ছে ডানা ইতিমধ্যে পেখম মেলেছে।শুরু হয়েছে শ্রাবণী উৎসব। যা আজ দুচোখে মুগ্ধতা আর খিলখিল অক্ষর নিয়ে সমস্ত স্বপ্নের হিমবাহ থেকে চুইয়ে পড়ছে অগণিত পাঠকের হৃদয়ে বিভিন্ন রঙের সংবাদ নিয়ে।
কবির সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি তাঁর এই কবিতা লেখার অনুপ্রেরণার মূলে একদিকে রয়েছে কন্যাশ্রী প্রকল্প এবং ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ অন্যদিকে রয়েছে জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত। এছাড়াও পেয়েছেন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী জীবনসঙ্গী সনৎকুমার গুচ্ছাইৎ বাবুর নিরন্তর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা।
প্রতিদিন মৃত্যু মিছিল, দূষণের বিভীষিকা, স্বেচ্ছাচারী মানুষের ক্লীবতা, তথাকথিত মানবসভ্যতার অপমৃত্যু, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বৃক্ষহীনতা এবং সুদূর পরাহত ধূসরতা থেকে তিনি শিক্ষা নিয়েছেন। তারপর সেগুলোকে সাথী করে তিনি কাব্যের বাগানে ফুটিয়েছেন নিত্য নতুন ফুল।তাই বলে হাঁড়িকুড়ির ভিতরে প্রাচীন গন্ধ, বিটোফনি সংগীত, দুপুরের রোদ, রঙিন ফুলের উচ্ছ্বাস, গল্প বলা বিকেল, ওষ্ঠ আর অধরের সংলাপ তার শিল্পের মহিমা থেকে বঞ্চিত হয়নি। বরং নিবিড় অনুরাগে তারাও পালতোলা নৌকার মতো ভেসে গেছে সমস্ত দারুচিনি দ্বীপ জুড়ে।

তাই পেশায় শিক্ষিকা এই কবির আলাদা করে পরিচয় দেবার দরকার নেই। কারণ শচীন তেন্ডুলকরের মত তাঁর ক্রীড়া নৈপুণ্য তথা লিখন শৈলী তার হয়ে কথা বলবে।
শুধু ভাষার সরলতা নয়, অসম্ভব সুন্দর চিত্রকল্প, বাংলা ভাষা ও প্রকৃতির প্রতি তার অন্তহীন ভালোবাসা এবং সর্ব ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা তার কাব্যকে করে তুলেছে আকাশ ভরা সূর্য তারার মত আলোকোজ্জ্বল। বিশ্বের মঙ্গলময়তায় কবির  বিশ্বাস ধ্বনিত হয়েছে বারেবারে। তার কবিতায় বিদ্রোহের বাণী নেই আছে  বিস্ময়ের জাগরণ। আছে মৈত্রী ও সংহতির সুর। আছে খরস্রোতা নব আনন্দের দিশা। একটু কান পাতলেই আপনি শুনতে পাবেন তার কবিতাগুলো যেন শৈশব ও কৈশোর লীলা শেষ করে যৌবনের পূর্ণ আনন্দে বসন্ত উৎসবে মেতে উঠেছে। যার রং আপনি না মেখে পারবেন না।
আগেই বলেছি কবি পেশায় শিক্ষিকা। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের পেশা তার কাব্য জীবনের নেশার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং তাঁর সাহিত্য সাধনার সহায়ক হয়েছে। হৃদয়ের ভাব মন্দাকিনীর ধারাস্রোতকে গভীর অনুরাগে ছড়িয়ে দিয়েছে জীবনের উপলখন্ডে। শুধু তাই নয় তিনি তাঁর সহজাত স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে সন্তান তুল্য ছাত্র-ছাত্রীর হৃদয় জয় করে সেখান থেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন কাব্যের ভেলা।সাধিকার মতো পবিত্র কমুন্ডল হাতে করে সাহিত্য সমুদ্রের পথে করেছেন দীর্ঘ পদযাত্রা। সেই পদযাত্রায় প্রতিটি ধূলিকণা তাদের পার্থিব জীবনের  বিষাদ,ক্লান্তি, পাণ্ডুরতা ঝেরে ফেলে লাভ করেছে অমৃতমধুর নব জীবনের আস্বাদ।

ইতিমধ্যে কবির কাব্যসংসারে এসেছে তিন নতুন অতিথি। সংখ্যাটা আগামী দিনে সগর রাজার সন্তানসন্ততির মত হয়ে উঠুক। তবু বলবো কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা দিয়ে কখনও কোন কবি বা লেখকের বিচার করা যায় না। খবর নিলে আপনিও ডাক পিয়নের মত জানতে পারবেন শ্রাবণীদির কাব্য সংসারে বৃষ্টির ফোঁটার মতো শিশির পড়ে। ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দিক চক্রবালে উড়ে যায়
"অর্বাচীন ও চিঠিরা"।উঠানের ছড়ানো রোদে মায়ের মতো
নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে "সমান্তরাল দুটি গাছ"।

সবুজ প্রাণ বৃক্ষ তার কাছে মায়ের মত। তাই তিনি গভীর ভালোবাসায় বলে ওঠেন," দুপুর এলেই / গাছেরা মা হয়ে ওঠে/ ক্লান্ত দুপুরের মাথায় ছায়ার মতো নেমে আসে/ অগণিত ডালপালা/ মায়ের কাছে শিখি / কিভাবে ছায়া হয়ে উঠতে হয়... "।( মা ও গাছেদের কথা)
পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধের ভয়ঙ্কর তান্ডব লীলা কবিকে ভীষণ কষ্ট দেয়। তাই সেই যুদ্ধের অবসান কল্পে তিনি লেখেন
" এই দুই হাত উপুড় করে দিলাম জল../ ধ্বংসের ভেতর থেকে শোক তুলে এনে / তুমি আমার কন্ঠে সাজিয়ে দিলে/ তারপর একদিন শেষ হবে সমস্ত যুদ্ধ.../ আমার কণ্ঠস্বর শুনে তুমি সেদিন নদী হয়ে যাবে।( তারপর একদিন)
মানুষের স্বার্থপর তায় ব্যথিত কবি গভীর আশ্লেষে লেখেন
" যতবার তুমি নদীর কাছে যাবে/ নদী তোমায় ভিজিয়ে দেবে/ যতবার তুমি গাছেদের কাছে যাবে/ ছায়া তোমার মুখ ঢেকে দেবে/ কিন্তু যতবারই তুমি মানুষের কাছে যাবে/ মানুষ তোমাকে দেবে জন্মদাগের পাশে ক্ষতচিহ্ন/ কেননা মানুষ এখন/ গাছ কিংবা নদী হতে ভুলে গেছে"( এখন মানুষ)
"অভিমান" কবিতায় কবির সুগভীর জীবন দর্শন মান-অভিমানের অনাবৃত নিবিড়তাকে ছোট ছোট সুখ দুঃখে বিভোর করেছে-" এইখানে নেই বলে, যেভাবে আমি নেই/ সে ভুল জানে/ না থাকার মাঝে থাকে কত থেকে যাওয়া / যে জানেনা,সে শুধুই দেখেছে/ চলে যাওয়া.. "

শুধু কবিতা নয় ইতিমধ্যে তিনি লিখেছেন বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং অনুগল্প। সেগুলো গ্রন্থ আকারে যথাসময়ে প্রকাশিত হবে। নীল আকাশে ডানা মেলবে আরও কয়েকটি স্বপ্নের পারাবত। উপন্যাস লেখার ইচ্ছাটাও রয়েছ তার মনের গহীনে। সময় সুযোগ পেলেই সোনার হাতের স্পর্শে আমরা দেখতে পাব আর এক
রূপকথার জগতকে। পৃথিবীর আশ্চর্য সরোবর থেকে প্রভাত পাখিরা গাইবে গান। সেই গান শোনার অপেক্ষায় আমরা রইলাম। কিন্তু ইতিমধ্যে যে বাঁশি তিনি বাজিয়েছেন, যে অপার্থিব সুর ঝরে পড়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সেগুলি হল যথাক্রমে - যুগ সাগ্নিক,কেয়া পাতা কচিপাতা,ধারাবাহিক,বিকল্প বার্তা,ছায়াবৃত্ত,সাজি, দূরে কোথাও,দৈনিক বজ্রকন্ঠ, সাপ্তাহিক ব্ল্যাক হোল,নতুন চিঠি এবং সোনালী দুঃখের মতো অজস্র লিটিল ম্যাগ।

তার একনিষ্ঠ সাহিত্য সাধনার ফলশ্রুতি হিসাবে তিনি  পেয়েছেন অগণিত মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা এবং প্রশংসা। পেয়েছেন কবি ঋজুরেখ চক্রবর্তী, কবি রেহান কৌশিক এবং কবি মধুসূদন দরিপার  মতো  অসংখ্য গুণীজনের নিবিড় সান্নিধ্য।এছাড়াও যুগসাগ্নিক পত্রিকার পক্ষ থেকে 2020 সালে তাকে "সবুজ কলম" সম্মানে ভূষিত করা হয়।
আগামী দিনে সবুজ কলমের মতো নানা সাহিত্যিক উপহারে তার ভান্ডার পূর্ণ হোক এই শুভকামনা রইল।

সাহিত্য অনুরাগী এবং সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হলেও শ্রাবণীদি গান বড় ভালোবাসেন। সময় পেলেই তিনি বসে পড়েন স্বরবিতান নিয়ে, যদিও সবটাই নিছক গান ভালোবেসে। সঙ্গে তাঁর সুযোগ্য পুত্র অভীক গিটারে সংগত দেয়। সাহিত্যের অনন্ত সম্পদ দিয়েই তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের গ্লানি এবং দুঃখ কষ্টকে জয় করে এক অনাবিল আনন্দ রসের জোয়ারে ভাসেন। প্রকৃতিকে বড় ভালোবাসেন কবি। তাই সুযোগ পেলেই সীমানা ছাড়িয়ে সীমানা পেরিয়ে চলে যান কোন নদীর তীরে,অজানা অচেনা গ্রামে কিংবা পাহাড়ের কোলে। পাখিদের গান, নিবিড় বনানীর হাতছানি, জলভরা দীঘি, হাঁটু জল থাকে ছোট নদী, গ্রামীণ মানুষের সরলতা এবং তাদের আঞ্চলিক সংস্কৃতি তিনি ভীষণ ভালোবাসেন।তাই তাই তিনি বলেন ".... কিছুই হয়নি দেখা/ নরম ঘাসের কাছে কান পেতে শুনে নিতে দাও/ সেইসব অশ্রুর কথা ঝর্ণার কথা/ শেষবেলায় পায়ে পায়ে সবকিছু চিনে নিতে হয়/ শব্দ কোরো না!"

না আমরা শব্দ করবো না। বরং তারিয়ে তারিয়ে তার অনির্বচনীয় সৃষ্টি সারাজীবন ধরে উপভোগ করব।
আপনি ভালো থাকুন দিদিভাই। আপনার আলোকোজ্জ্বল সাহিত্যিক জীবন কামনা করি।

মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা-র তরফ থেকে শ্রাবণী গুপ্ত এবং বিশ্বরূপ দাস, উভয়কেই শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানালাম।

No comments:

Post a Comment