Saturday 25 December 2021

পৌষালি সংখ্যা || সম্পাদকীয় নয় কিন্তু

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  অভিজিৎ দাসকর্মকার 





সম্পাদকীয় নয় কিন্তু 


আমি ১৪ ই নভেম্বর, ২০২০ সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ও প্রকাশনার সম্মাননা অনুষ্ঠানে অবনীন্দ্র সভাঘরে আনুষ্ঠানিক ভাবে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম, কবি মন্দিরা ঘোষ এবং কবি রিতা মিত্র কে মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য হিসাবে গ্রহন করতে ইচ্ছুক।তাঁরাও সম্মতি প্রকাশ করেন এবং গ্রহন করেন। 

    
    কবি রিতা মিত্র                                          কবি মন্দিরা ঘোষ                                                                                                                                                                        
সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য মানে আমার আমাদের একটা টিম।তাঁদের মতামত,তাঁদের পছন্দ, না-পছন্দ সবের কদর এবং গুরুত্ব দেয়া। আমি তাঁদের নিয়ে এই প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করছি, যাঁরা মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকায় আগে কখনো লেখেন নি। কবি মন্দিরা ঘোষ এবং কবি রিতা মিত্র, আপনাদের পাশে পেয়ে আমি খুশি, আনন্দিত। বিশ্বাস করি আমরা একসাথে সুগঠিত কাজ করতে পারবো। 

আমরা সেইসব কবিদের অনেক ভালোবাসা জানাই, যাঁরা আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন।এ পত্রিকা আপনাদেরও।


পৌষালি সংখ্যা || অজিতেশ নাগ

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  অজিতেশ নাগ 


অব্যবহৃত 


মানুষ মানে তো শুধু তুমি আমি নই,

আদিগন্ত চা বাগানের শেড-ট্রির নিচে অনাহারে মরে থাকা মানুষটাও তো ছিল,

ছিল মাসে একদিন ঘরে ফেরা নোনাজল উজিয়ে মেছো বাতাসে গা ভেজানো মানুষটাও,

ফিরে যখন যেতে পারছি না উলঙ্গের দেশে,

তখন কাপড়ের নিচের আমি-মানুষটা তো সবটাই রক্তমাংসের কাঠামো

আমরা মানে তো শুধু আমি তুমি না,

গাইতি হাতে ঝড়ের সামাল দেওয়া কাকে বলে দেখেছ কোনওদিন?

 

আমি সমুদ্র নই, আমি নুলিয়া নই, আমি মৃতদেহও নই,

অব্যবহৃত কোন চাবির মত পড়ে থাকি ঘরের সামনেই,

তুমি হয়ত আমায় এঁটো চাঁদ নিয়ে কবিতা লিখতে দেখনি; কিন্তু - 

দেখেছ কি নিপুন যত্নে আমি তোমার সেমিজ সেলাই করি?

 

 

যেখানে এখন আমি

 

আর কোনদিনও চিঠি আসবে না,

আর কোনও ডাকঘরের ঠিকানা খুঁজে পাবে না কোনও সামান্য পোস্টকার্ড,

দেশ বিদেশের ডাকটিকিট ছোপানো রঙিন অথবা সাদাকালো,

প্রায় নোংরা হয়ে আসা জীবনের কথাগুলো সম্বল করে,

আর আসবে না এই খোয়াইয়ের চরে

যেখানে এখন আমি,

জানতাম কীভাবে একতারা, দোতারা, তিনতারা হয়ে উঠে যাওয়া যায় সপ্তসুরে,

সপ্তডিঙা ভাসিয়ে দেবার প্রাক্কালে।

ঠিক এখন যেখানে আছি, তার অনেক উপরে অনেক কাক, চিল, অর্ধ-উন্মাদ পাখীর দল,

অনেকদিন কাটিয়েছি ওদের জীবন, নারীসঙ্গ, কবিতা আসর......

আস্বাদিত তৃণের শাকাহারি জিভ ছুঁয়ে পড়ে আছি পরম শান্তিতে

আর কোন পুর্ব-আদেশ মত চিঠি লিখতে রাজি নই আমি

 

 

বিছানা-বালিশ 

 

যদিও এই বিছানা-বালিশে লেপ্টালেপ্টি করে আছি,

তবু চাইলেই কি ফিরে যাওয়া যায় সেই বাদুরের দেশে,

সেথায় কোন এক প্রাগৈতিহাসিক সন্ধ্যেতে,

বিশাল ঘরের এক প্রান্তে রাখা চারশ বছরের পুরনো পিপেতে রাখা মদ,

চুপিসাড়ে একঢোক পান করে ফিরে যাবার সময়েই,

বিষাক্ত অবিশ্বাসে হা হা উড়ে গিয়েছিল বাদুরের দল,

আমার অস্তিত্বকে বিশ্বাস না করেই

তবুও আজও বিছানা-বালিশে সেই অস্তিত্বের স্বাদ মাখিয়ে রাখি,

ভুলে যেতে চাই ঘরছাড়া বাদুরের মত 

আমি চলে গেলে এই বিছানা-বালিশ বেচা হবে দারুন সস্তাদরে

 

 

ঘুম চাই

 

আমার হৃদপিণ্ডের নিচে দমচাপা প্রেম এক-ঠ্যাং ভাঙা কাকের মত
দাঁড়াবার অতি প্রচেষ্টাতবু নানা সাংসারিক অক্ষমতানাড়িছেঁড়া প্রতিবন্ধকতা
বিশ্বাস না পেতে পেতে নাক দিয়ে অবিশ্রাম শ্লেষ্মার মত বেড়িয়ে আসে দম
কখনো শিশুর মত ঘুম চাই। 
আমার ফুসফুসের নিচে দমচাপা প্রেম কোমরে দড়ি দেওয়া বাঁদরের মত
কত অহংকারে রাত জেগে থাকে কত সাম্রাজ্যের বৃদ্ধা রাজকুমারীরা
তবে তাঁরাও জানেঘোরাফেরা তাঁদেরও অলিন্দেবড়জোর বাতায়নে
তা নিয়ে একটা স্বরচিত কবিতা হয়নারীজন্ম সার্থক হয় নাতাই
এখনই শিশুর মত ঘুম চাই। 
সিন্ধুনদের ওপর দিয়ে যে বক বাতাসে ভাসার স্বপ্ন দেখেছিল
তারও বন্ধুত্ব করার সাধ আমার এঁদো গলির সেই এক-ঠ্যাং ভাঙা কাকের সাথে
নিমেষে যৌনমূর্তিমৌনমূর্তির রূপ পরিগ্রহ করে আমায় আরও জাগাতে চায়
এইমাত্র শিশুর মত ঘুম চাই।

 

 

বোকা চাদর 

 

যে সব নারীর দেহ আরও গলে, আরো খানিকটা পচে গেছে,

তাদের ফোঁপানি চাপা দিই অনির্মিত বোকা চাদর দিয়ে,

ওদের মধ্যপ্রদেশ ফুলে ঢোল, হাত-পা-আঙুলে বেনামা নির্দেশ,

দূরবীন রেখো বন্ধু হাতে,

        আমরা সুরক্ষার দুর্গ থেকে ওদের শোভাযাত্রা দেখব,

        বেমক্কায় জ্ঞান-ফুল ছিঁড়ে রেখে দেবো,

        টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেবো ওপর থেকে,

        তবে সাথে রাখব নিশ্চিন্ত নিরাপদ দুরত্ব

আর যে সব নারীর দেহ অবাক কংকাল,

আমোদের ঠাসবুনুনি  ওদের এভাবে পাওয়া সমীচীন নয়,

নাকে কাপড় চাপা দিয়ে চাইলে খুঁজে দেখতেই পারো;

ওই নারীদেহের মজ্জাহীন হাড়ের ভিতর ভালোবাসা  গুপ্তধন





পৌষালি সংখ্যা || শকুন্তলা সান্যাল

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা || শকুন্তলা সান্যাল 



গঙ্গা  বহতা


কিছু কি সংকেত রেখে যায় নাভির পুড়ে না যাওয়া টুকরো?
হয়তো নিশ্চুপে বলে, দেখে দেখে তুমি শিখে নিও 
প্রলয় শেষের ভালোবাসা..,
যা প্রবাহিত গঙ্গার মতোই প্রিয়।

কিছু কি সংকেত রেখে যায় সবুজ বৃত্ত?
যা নিশ্চুপে বলে, দেখে দেখে তুমি শিখে নিও
গাছেরাও ছোটো বড়ো, কেউ বিখ্যাত কেউ অবিখ্যাত।
 শিখে নিও ক্লোরোফিল চারুকলা..,
যার ছোঁয়ায় গঙ্গার শান্তি আছে।

কিছু কি সংকেত রেখে যায় ঋতু পরিবৃত আকাশ?
যা নিশ্চুপে বলে যায় দেখ,কখনও ঝকঝকে বা মেঘলা বা 
কিছু কিছু মেঘ আছে হয়তো ,
বৃষ্টিদিনে হয়তো  তাকালেই না , কিছু পর দেখলে 
জ্যোৎস্নায় ভেসেযাচ্ছে চরাচর,জীবনও যেমন!
আকাশ দেখে অনুভব কর যেন বহতা গঙ্গা... 

আমাদের এই নির্বাণমুখী প্রবাহমুখী  অথবা বিপরীতমুখী চলাচল, 
যার সবটুকুই ভালোবাসার দরুণ অথবা নয়,
অথচ যে সূক্ষ্ম দেহটির নাম 'শান্তিকামী'
যা ছিলো আছে থাকবে ...!


এঁকে গেছে গঙ্গা 

সেদিন গভীর রাতে ফিরে,বারবার ফিরে যাচ্ছিলাম  
একটা শব্দহীন দাউদাউ বৃষ্টির কাছে।
অস্তিত্ব শুধু আলোয় এমন পোকারা 
বোকা ঝড়ের সাথে ঘুরছিলো,হয়তো উড়ছিল না,
হাওয়ারা চলছিলো বলে গা ভাসিয়ে রেখেছিল।

আমার দুঃখ বোঝার অনুভূতিটা ফিনফিনে টিনের পাতের মতো, 
কখন যেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে ধার মুড়ে বসেছিল ।
তেমনি চুপ করে থাকতে থাকতে  অসাবধানে
পাতটা মধ্য রাতে ঝনঝন ঝনাৎ শব্দে মেঝেতে পড়ে গেল।
আমি তফাতে থেকেই অমন আচমকা আবেগে খিল তুললাম।

আমি তো তফাৎ এ থেকেই.. 
মা'কে বিদায় দিয়েছিলাম!


থমকে থাকা পাখি

আছড়ে ফেলি আমার আমিকে, 
ওকে স্তাবক বলি।
পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে চিপ্টে দি ওর কান্না।
আবার ভাত বেড়ে দি,অসহায় বলে কাছে ডাকি ।
দৃষ্টি নন্দিত নৌকার মাঝি মনে হয় নিজেকে।
আবার স্তাবকের চোখে গঙ্গার রূপ দেখতে থাকি।
আমি কি থমকে থাকা পাখি?

গঙ্গা গঙ্গা বোধে

আমি পরম হাঁস হতে চেয়ে হয়ে আছি ব্যাঙাচী 
বুকে আমার গঙ্গা প্রবাহ, 
চোখে ঘোরে প্লাসটিক জীর্ণ ক্লান্তি ।
আমি পরম হাঁস হতে চেয়ে 
হয়ে আছি  প্যাঁক প্যাঁক বাগীশ ।আমি আছি,আমি আছি বলি,
তবু কচুরীপানা বলে আমি নেই আমি নেই ।
এ শুধু আমার নৈঃশব্দের ঝংকার,শুনতে পায়না কোলাহল ।
কেউ নেই কেউ নেই আমিও না!
বহতা গঙ্গার বুকে ভাসছে, ভাসছে যাতা?

শান্তি কই শান্তি কই ?গঙ্গা তো বহতা..।


গঙ্গার বুকে দুঃখ পেতে নেই  


তখন কি আর কাঁদতে আছে
গঙ্গার বুকে যখন ভাসছে প্রমোদতরী?
পুতুল খেলা কিশোরবেলা,
বাদ কি গেছে সবি?

ভেবে তো নিতে পার, তর্কে হয়েছ বিজয়ী!

রাগ টাগ অন্তর জ্বালা নিভিয়েছে বান্ধবী ।

ভেবে তো নিতে পার,এক একটা কালো রাত্তির 
ছোট হতে হতে ছোটো কালো তিল
বরাত পেয়ে এসে বসে আছে ঠোঁটে,
আর ঘুরে যাচ্ছে তিলোত্তমায় সিনেম্যাটিক রিল..

অনুমান থেকে নেমে আসে প্রশ্নপত্র জেন,
হয়তো বিতর্ক আবার উস্কে দেবে মাথা!
দিঘি বাতাস পেলে মাখোমাখো হবে
এতো জানা কথা।
এমন কিছু  ভাবনা সেতো একি মাথায় গড়া!

গাছ টাছ তুমি কি হতে চাও !
আনমনা শৃঙ্খল মেঘবতীকে পরাও?

যদি বৃষ্টি বৃষ্টি নিম্নচাপ তোমায় চেপে ধরে,
যদি বান্ধবী কাঁচের বাংলোয় 'বৃষ্টি পোহাই আয়'বলে,

তখন কি আর কাঁদতে আছে?
যখন গঙ্গার বুকে ভাসছে প্রমোদ তরী!
পুতুল খেলা কিশোরবেলা 
বাদ কি গেছে  সবি?


পৌষালি সংখ্যা || সূর্য মণ্ডল

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  সূর্য মণ্ডল 


মৎস্যন্যায় 

 মাছ কাটার বোটি ইস্পাতের হলে
সহজেই দ্বিখণ্ডিত হয় দেহ

আর আমি বধ্যভূমিতে চণ্ডাশোক
নির্দেশ দিচ্ছি তর্জনীর নাড়িয়ে
ঠিক কোন খণ্ডে 
কতটা মাংস থাকা উচিত। 

স্রোত
 
রক্ত উচ্চভূমি থেকে কচি লাউ দগার মতো
ছুটে যায় অববাহিকার দিকে
অথবা চুইয়ে পড়ে দিল্লি থেকে 
নুলিয়া পাড়ায়

আর সব স্বাভাবিক 

বনে বাঘ 
গাছে পাখি
পাখি পাকা ফল খায় 
আর ডানা মেলে ওড়ে...

তৎকালীন বঙ্গ সমাজ

গ্রীষ্মের দুপুরে স্থির জলে টপ করে খসে পড়েছিল একটা মেয়াদ উর্ত্তিন পাতা।

গ্রীষ্মের দুপুরে তরঙ্গ উঠেছিল জলে।
দুপুরে তরঙ্গ স্পর্শ করেছিল আমাদের মাতামহীর সপ্তদর্শী স্তনবৃন্ত। 

তারপর থেকে সে রোজ একা একা স্নানে যেত

এরই মধ্যে একদিন সে কী ভাবে যেন পা হড়কে
তলিয়ে গেল চন্দ্রজ্যোতি ঢেউয়ে।

একমাত্র রামতনু লাহিড়ি এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য জেনেছিলেন। 

আমরা
এখনও অন্ধকারে...

তবুও
 
ইতিমধ্যে কতজনই তো গেল 
কিন্তু কেউ যাওয়া আগে আসছি বলে যায় না
নিদেনপক্ষে ভালো থেকো তাও বলে না

অথচ আমি নীরবে তাদের এগিয়ে দিই যতদূর পারি


পৌষালি সংখ্যা || ফাল্গুনী দে

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  ফাল্গুনী দে



দ্রোণাচার্যকে 

এতই যদি একলব্য ভয় 
গায়ের জোরে আঙ্গুল রক্তাক্ত হয় 

অর্জুনের সাথেই তবে যুদ্ধ আজ 
বর্মখানি খুলে রাখো হে তীরন্দাজ 

দলিতের নেই ন্যায়ের অধিকার 
বলো, এই হেনস্থা কি শুধুই আমার ?


মায়ার খেলা 

যাও, সোনার হরিণ খুঁজে আনো বলে 
যাকে ক্লান্ত ছুটিয়ে মেরে 
অপেক্ষায় থেকেছি লক্ষণরেখার আশ্রয়ে

দিনের শেষে সে যখন সত্যিই
সোনার হরিণ হাতে সামনে দাঁড়ায় 
তখন তাকে রক্তমাংসের মানুষ বলেই মনে হয়
 
ঈশ্বরওতো কখনো কখনো ভুল করে 
মায়ার পেছনে ছোটে !


লোডশেডিং 

লোডশেডিংয়ের ভিতর অন্ধকার হাতড়ে
                     পেয়েছি আলোর মজলিস
পাটভাঙ্গা আঁচল প্রিয় হ্যারিকেন হাতে 
                                নক্ষত্রমালা খোঁজে

নাগরিক যাপন ভুলে রূপকথার সামনে
                           হাঁটু মুড়ে বসে জীবন 
অন্ধকার সিঁড়ি বয়ে অতীত উঠে আসে 
                              আকাশের গ্রীনরুম

আলো নিভে গেলে সম্পর্ক গভীর হয়
ভাঙ্গা পিয়ানোয় কাঁদে মুনলাইট সোনাটা
অন্ধকার বলে দেয় গোপন অলিন্দ ব্যথা
                     টানেলের গায়ে হায়রোগ্লিফ

তুমি তো গোপন করোনি কিছু আয়নায়
              তবু অন্ধকার কেন প্রিয় মনে হয় ?
কেন বিষন্ন রঙের চাদর আজ ফিনিক্স পাখি 
                       ঘুমের ভিতর জিয়ন উৎসব ? 


তোর লাগি মোর ভীমরতি

তখনো গুটি পায়ে হাঁটছে ঘরভর্তি লেটনাইট আলো
অ্যাস্ট্রেতে জমে ওঠে কিছু ছাইরঙা মরা আগুন

দূরের ঝাপসা নীল আটকে থাকে শহরের চুপকথায়
কিছু অন্ধকারই আমাকে চিনে নেয় নিজের মত করে

কড়ি বরগায় বাদুড় ঝুলে একটি দ্বীপ হয়ে বেঁচে থাকি
আমার একান্তে -- তোর প্রিয় শহর কলকাতায়

দেরাজ ভর্তি মেঘ গুমোট হাওয়া বৃষ্টির তোড়ে উড়ে গেলে
আমি তোকে তেষ্টায় মেখে গিলে গিলে খাই আজও

যেটুকু মনে রাখিস সেটুকুই আমার ফুসফুসের বাতাস
বাকিটা জানে ভোররাত -- আমার পাপড়ি শুয়ে থাকা

খোলা রইল পূবের জানালা আর ডাইরির পাতায় তুই
কিছু কথা না বলা থাক পান্ডুলিপি খুঁজে দেখে নিস্।


সোনার তরী 

আমাদের নতুন বাড়ির ছাদ উঠে যাচ্ছে আকাশে
তারার গায়ে এলোচুল মেঘ পাশাপাশি গা-ঘেঁষে 
                                     বসে থাকে আঙুলে আঙুল

ছায়াপথ ধরে নেমে আসে সুখ মহারাত্রিকথা
চিলেকোঠা থেকে বাবা মেলে ধরে পতাকা গাঢ় সবুজ
মা জ্বেলে রাখে সাবেক আকাশ - প্রদীপ

নীচে তখন প্রতি স্কোয়্যার ফুটের হিসেব লাভ লোকসান
বিপরীত নিয়মে উঠে আসে গা-ধোয়া কৈশিক জল
রামধনু নিংড়ে আনে দেওয়াল জোড়া প্রিজম আলো

লোহা লোহা কাঠ কাঠ বালি বালি পাথর পাথর
আজ আর মনে নেই কত ঘাম দিয়ে সিমেন্ট কিনেছি কত
চৌকিতে এলিয়ে ক্লান্ত শরীর ধুলো হয়ে গেছে কবে

আরও নিচে তখন জীবাশ্ম কান্না। পুরানো বাড়ির মৃত কঙ্কাল
দেহাতি চুনকাম আর এলেমাটির কবরে বাঁধানো মার্বেল
আমাদের শিশুবেলা আঁকা ছিল অনটন - আহত কোলাজে।




পৌষালি সংখ্যা || শান্তনু ভট্টাচার্য

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||   শান্তনু ভট্টাচার্য  


ছবি

  
ঘরের সামনে 
দাঁড়িয়ে আছে একটা চৌকো অন্ধকার।

তার গা-য়ে আলো পড়লেই 
বেঁকে,কুঁকড়ে ছোট হয়।  আলো সরে গেলে
আবার  বড় হয়ে যায়।


তার গায়ে কিছু রঙিনপাতা আর শিশুর মুখ
এঁকে দিতেই কলকলিয়ে হসে উঠলো অন্ধকার 

চাঁদ তারা আঁকবো কি না 
ভাবতে ভাবতেই দেখি 
অদ্ভুত ফুলের গন্ধ সব আমার শরীরে মাখামাখি ।


ঠেক

আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি 
একটু পরেই ঝুরো বরফের মতো
সেখানে নেমে আসবে সন্ধ্যা।

বাতিস্তম্ভের পাশের রেলিং এর গায়ে হেলান দিয়ে  শূন্যস্থান ভরে দেবে
নীল ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক লাগানো 
কিছু ছায়া ছায়া মূর্তি।

শিয়াল কুকুরের মাংস হলেই যথেষ্ট,
সেই মহাভোজে মেতে ওঠে আকাশের তারা...চাঁদ...রাতের বৃষ্টি আর
দূর নিওনের সারির মতো চাট আর জল এনে দেবার খতেন।
দরকচা মারা নগদ প্রেমের কালশিটে দাগ লেগে যায় 
তাকে ধোবে বলে নদীতে নেমে পড়ে গোটা রাত। 

ক্লান্ত খদ্দের টলতে টলতে ফিরে গেলে  
নদীর বুক থেকে পুণ্যস্নান সেরে
উঠে এসে দাঁড়ায় ভোর...বাতি স্তম্ভের গায়ে।

বেলা বাড়লে 
রোজগারের মত যেখানে এসে দাঁড়াবো আমি।


কবিতার অ্যারোমা

যেভাবে চারিদিকে কবিতার বই ছড়িয়ে রেখে 
দুপুরবেলা একান্তে শুয়ে থাকো তুমি 
ঠিক তেমনিভাবে চারপাশে নুড়িপাথর বিছিয়ে 
উপুড় হয়ে শুয়ে আছে একটা নদী। 

তার গায়ে ভাঙ্গা আয়নার কাঁচের মতো 
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দিনের আলো।
সন্ধ্যা নামলে তার কাছে যাই; পাশে বসি 
বুক ভরে টেনে নিই সেই নদীর অ্যারোমা।

আকাশ ভরা নক্ষত্রের মাঝে কালপুরুষ
ঈর্ষায় লাল হয়ে ওঠে। তির নিক্ষেপ করে
অযুত আলোকবর্ষ সুদূর হতে।

পাখির মতো ফিরে যাই...
ফিরতেই হয়।কোনোদিন
মনখারাপের গোধূলিতে পড়শি নদীর কাছে এলে
তোমার কথাই মনে পড়ে বারবার  
আর নিঃশ্বাসের মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে
সেই অ্যারোমা  ছাড়তে থাকি বাতাসে 

তখন কংক্রিটের জঙ্গলে যেন আশ্চর্য ম‍্যাজিক ----

তোমার শরীরের গন্ধের সঙ্গে মিশতে মিশতে 
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়তে থাকে কবিতারা।

নিশীথ আহিরী
          
এক ভিন্ন পৃথিবীর মধ‍্যরাতে
মানুষের পায়ের ছাপ না-পড়া অরণ‍্যে
ঠিক লুব্ধকের নিচে পাথরের ওপর 
বিরহিনী এক তারা কাঁদতে থাকে।

আকাশগঙ্গার প্রবল স্বান্তনাস্রোতে ভেসে ভেসে
অযুত তারারা নেমে বসলে ঘাসের ডগায় ডগায়,
গাছের অন্ধকারে নিজের আলো নিভিয়ে 
মুগ্ধ বিষ্ময়ে তাদের দেখতে থাকে বনজোনাকির দল।

একটানা ঝিমধরানো সেই  কান্না 
শুদ্ধ কোমলে মিশে ধ্রুপদে ভেসে যায় বাতাসে...

রোদের সকাল হলে
পাখিরা শিকারের গন্ধ  ডানায় মুছে 
আদিগন্ত ঘাসবন তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখে-
নিশ্চিহ্ন রাতের  ফসিল পড়ে আছে।

খাওয়া 

খাবার খাওয়ার একটা নিয়ম আছে 
শক্ত হলে চিবিয়ে খাও
তরল হলে গিলে খাও 
চোষার হলে চুষে খাও 
চাটার হলে চাটো
সমস্ত খাওয়ারই নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে 
মোটামুটি সবাই তা মেনে চলে।

অসহ্য লাগে তখন যখন কেউ আলোকে 
কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়ে প্রমাণ করে 

আলোর শরীরে কোন হাড় নেই...



পৌষালি সংখ্যা || অজন্তা রায় আচার্য

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  অজন্তা রায় আচার্য 



জানালার সাত রঙ 


১/

যেভাবে নদী লিখে রাখে জলের নামইতিবৃত্ত

নিজের ভেতর থেকে নিজেকে ছাপিয়ে ওঠে জল

ফুলে ফুলে উঠে তার গর্ভ নতুনের সৃজনে

আকুলি বিকুলি টানের কাছে একান্ত নতজানু  

স্বরবৃত্তের চলন কখনো রুদ্ধ,কখনো মুক্ত

খানিক স্তব্ধ শব্দবন্ধ ধরে রাখে নিস্তব্ধতাকে 

অথবা ধুয়ে মুছে দিয়েছে বুঝি নিজে নিজেকেই

খুব সহজেই কি চেনা যায় তাকে?  

জলে ডুব দিলে নদীর অস্তিত্ব নেই

পাড়ে বসে থাকলে জল ছুঁতে পারি কই

 

২/

ঘুম ভেঙে গেলেই স্বপ্ন চুরচুর হয়ে যায়

ক্রমাগত বিদ্ধ হতে থাকি

ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্য, যোগফল মেলেনা  

 এলোমেলো চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি  দূরের দিকে 

 শূন্যে ধরতে   

স্বপ্নের মধ্যে যে বিশ্বাস থাকে ছুঁতে চাই তাকে

বুঝিনা, পেয়ে হারাবার দুঃখ বেশি, নাকি না পাবার   


ঠিক তেমন একটি ঘুমের অপেক্ষায়,

আর ফিরে আসেনা

 

৩/

বন্ধ ঘরে জমাট অন্ধকার

কিছুই নেই শুধু শূন্যতাটুকু ছাড়া, কি দিই বলতো !

হতাশার হুতাশন গ্রাস করে নেবে , দূরে থাকো

একই গোলের মধ্যে আটকে আছি 

অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে, এই টুকুই তো আমার

এ অন্ধকার প্রতিবিম্ব ধরে না    জানো? 

ফিরিয়ে দেবে বার বার, তবু যদি আসো

আমিও তো সূর্য লোভী। 

 

 ৪/

রাত্রির নক্ষত্র চোখে সম্মোহনী কাজল   

 ঘন কালো এলোকেশে বন্দি 

সে বিলিয়ে দেয় নিজেকে, নাকি আমি? 

তলিয়ে যাই ঘোর আশ্লেষে

পরিয়ে দেয় বিস্ময়ের মালা

 শরীরে পাখি জেগে ওঠে

 পাখায় লাগে সাত সমুদ্র তের নদীর প্রেমিকার ঘ্রাণ   

রাত্রির রহস্য  এক অথৈ প্রেমের সমুদ্র  

 হাবুডুবু খাই   সাঁতার কাটি, অবশেষে ক্লান্ত

ঘুম ভেঙে যায় ভোরের পাখির ডাকে।।

 

 ৫/ 

কালো রাত্রির সাথে মিশে আছে বাতাস

অন্ধকারে নত হয়ে আছে গাছ

সূর্যের প্রথম আভায় খুঁজছি পাপঘ্ন জল

 

 ৬/

সমুদ্রের নীল ঢেউএর উপরে সাদা ফেনা

ফেনার উপরে খেলা করে সোনালী মাছ

সোনার মাছ ধরবো বলে সাঁতার কাটছি অনন্ত 


 ৭
/ 

 বার বার পথ ভুল করি,ধ্রুবতারা ওঠেনা

সমুদ্রচরের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে সুন্দর লাল কাঁকড়া

সব পথ হারিয়ে ফেললে জন্ম টান দেয় আবার


 ৮/ 

  কুয়াশার মধ্যে থেকে জাগে নক্ষত্ররা

বেজে ওঠে আলোকিত ঘুঙুরের বোল

হেমন্তের বিকেলের পরে  সন্ধ্যা শেষে  

কি সংকেত দিয়ে যায়  রহস্যতে ওরা

 

কুয়াশার আস্তরণে বুঝি এসেছিলে

সেই কথা বলে সদ্য ফোটা রূপকথা

কুয়াশার মতো ভেঙে যায় নিঃসঙ্গতা

ব্রহ্মচর্য অবসান হলো এই বেলা

 

মৃত্যু মতো নেমে এলে দুচোখের কোলে

 এইবার বুঝি মুক্তি হলো শীত থেকে।।