Tuesday 31 May 2022

মে সংখ্যা || প্রচ্ছদ

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||   প্রচ্ছদ করলেন শ্রীমহাদেব






















                          ------------------------------------------------



মে সংখ্যা || সূচি

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  সূচি || 




মে সংখ্যা || সম্পাদকীয় নয় কিন্তু

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||   মন্দিরা ঘোষ 


সম্পাদকীয় নয় কিন্তু 

আবারও প্রথম থেকে।আবারও স্বরবর্ণে স্বর ফুলিয়ে  অঙ্ক খাতার পাতায় মেঘ বৃষ্টি  তারা আঁকি না কেন! কাগজের নৌকো ভাসিয়ে শ্রাবণ  শ্রাবণ চোখ।বুকের ভিতর মিছিমিছি জলফড়িংয়ের হাঁকডাক।জুঁই  আর  ভুঁইচাঁপার বাড়াবাড়িতে রজনীগন্ধার শাসন মিথ্যে তো নয়!একচিলতে ওড়নার ছটা বা শার্টের রোদ্দুরে   বুকের পেন্ডুলামে ঘন্টা বাজাতে ছুটে আসে হাজার খানেক নাম না জানা পাখি । একটু খানি ছোঁয়ার দাগে চন্দনের গন্ধ।

হোক না আবার শুরু প্রথমভাগের  আলোয় শব্দ স্বরে আঙুলগোনা অথবা একটা বাড়াবাড়ি রকমের কিছু!ধোঁয়া উঠুক।জ্বলুক আগুন।
তসর কথার ভিড় সরিয়ে  জখমিতে নুনের গ্রহণ লাগাও! আলবিদা লেখা চিঠির কোনায় চাঁদের তোতলামি এঁকে নতুন কোনো স্কেলে বেঁধে ফেলি চলো একতারের বায়না। শব্দের থই এসে সুশীল করুক ঘাটতি।কবিতা ফলাই  উঠোন কুয়াশায়।বন্ধু আঁকি যেমন খুশি। চলতে ফিরতে গানের হরমোন ইনজেক্ট করি শিশির শিরায়।দিনের সম্পাদকীয়তে রাতচরা পাখি এসে ঠুকরে খাক ফলের আঁঠা।তবুও চলো নতুন লিখি। কবিতা সাজাই। তোমাদের ডাকি নতুন নামে। তোমরা সাড়া দিলে ঠিক  ফুলে ফলে ভরে যাবে আইভরি পাতা।



মে সংখ্যা || কবিতায় সৈয়দ কওসর জামাল

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  সৈয়দ কওসর জামাল


স্পর্শদোষ


শবাধার প্রস্তুত করেছ। নেমে যাই তবে ওই চোখে?

এত শান্ত এমন কোমল দৃষ্টি আমাকে পাখির স্পর্শ দেয়

স্পর্শ এক প্রেমাতুর, নাবালক জন্মের রোমহর্ষক স্মৃতি

যেখানে কেটেছে দিন গাছে গাছে, গ্রীষ্মবর্ষা শরৎ পেরিয়ে

কঠোর শীতের দেশে,  চেয়েছি কুসুমস্পর্শ, ফলভার

কখনও কোটরে তার খুঁজেছি শালিকছানা, পাতার ভিতরে

বটফল ঠোঁটের পাখিটি অজান্তেই উড়ে গেছে দূরে

কুয়াশায় ডুবে থাকা তোমার দুচোখ আমি দেখিনি কখনও

দেখিনি প্রহরা কেন মৃত্যু্র সীমানা ঘিরে বেড়ে উঠেছিল

সব সতর্কতা পূর্বাভাষ হাওয়ায় উড়িয়ে অমঙ্গল বাজে

কেঁপে ঊঠেছিল চোখ, পাগলা ঘন্টি যৌবনের দিন

চলে গেল তোমার হৃদস্পন্দন দ্রুত করে দিগন্তের দিকে

তাই এই জন্মঘোর, মৃত্যুঘোর, মৃত্যুর পরের মায়াঘোর

দুই চোখে সাজিয়েছ অন্ধকূপ, ঝাঁপ দিই মৃত্যু বাজি রেখে

পাতাল প্রহরে বুঝে নিতে চাই আমাদের যাকিছু আপস 

তোমার শীতল চোখে আমি রেখে আসি তবে যত স্পর্শদোষ।



মে সংখ্যা || কবিতায় সমরেশ মণ্ডল

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  সমরেশ মণ্ডল


ভিজে যায়, মনের আঁচ

ভোর ভোর ভাগ্যিস আসিসনি, আলো উড়ে যেত
সেই আলো যার জেরে ভীষণ মায়াবী হয়ে পড়ত।
আজ আর পড়ে না-কেননা আলো ক্রমাগত চুঁইয়ে
পড়ে ত্বক থেকে মনের দেওয়ালে, ভিজে যায়,
মনের আঁচ পোহাতে হয়।

                                                              মুখে আলগা সৌন্দর্য খোলে
আমি তাকে কিছু দি নি তবু সে শান্ত হয়, অনেক ভিড়
ঠেলে উঁকি দেয়-আর কী করে?

                                                              অনেক দিন পর সে একদিন বলে,
তুমিই আমাকে শান্ত করে দিতে পারো'
                                                              কেন পারি ? আমি কেন পারি!

আলো হয়, বাতাসে হেরফের হয় - গলা থেকে
কাঁধ থেকে মায়াবী ভাঁজের অর্কিড থেকে
দুর্লভ সুঘ্রাণ এসে বলে ঐতো ডায়েরি ঐতো নিদারুণ
কলম, তুলে নাও তুলে নাও-দেবীকে ডাকো
তোমার-সময়ের-সুন্দরীদের ডাকো

আর ওই যে পুলকারে দূরের স্কুলে পড়াতে যাচ্ছে
ওর মুখে ওর মনে বসিয়ে এক একটি
ছবি আঁকো তারপর চার ফর্মা পাঁচ ফর্মা পান্ডুলিপি
বানাও… ভোর ভোর ভাগ্যিস আসিসনি, আলো উড়ে যেত।


মে সংখ্যা || কবিতায় ফটিক চৌধুরী

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||   ফটিক চৌধুরী



খোয়াইয়ের পথে

আমারও কিছু ভালোলাগা থাকে
পবিত্র ও নিঃসঙ্গ
তাকে উদ্ধৃতি দিয়ে কি করে বোঝাই !
কিছু শব্দ চয়ন করি উড়ে আসা
বসন্ত বাতাসে
মৃদু অভিমান লেগে থাকে পলাশে শিমুলে।
হরিতকি গাছের কাছে কিছু কথা
রেখে গিয়েছিল যে নির্মল কিশোর
খোদাই হয়ে আছে তার বুকে, আজীবন।
নিজেকে যদি ভাবি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা
উদাসী পথ ঠিক যায় হেঁটে, খোয়াইয়ের পথে।


মে সংখ্যা || কবিতায় শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  শ্যামশ্রী রায় কর্মকার 


চোখ

কত শক্তিমান তুমি ভেবেছ নিজেকে? 
অবশিষ্ট পৃথিবী নির্বোধ? 
তোমার  আঙুল শুধু জালবিস্তার জানে  
কার্যসিদ্ধির মোহ, টোপ 

আমরা হাঁ মুখ শুধু?
গিলে নেব? দেখে ফেলব না
তোমার চাণুর-মুষ্টি, বিষাদকালীন ভয়
প্রতিশোধস্পৃহা নামে যত বিস্ফোরক? 

যাকেই শিকার ভাব, সে আসলে চোখ
সে তোমাকে দেখে ফেলে, চিনে ফেলে তোমাদের
দুগ্ধভানাবনত যাবৎ পূতনাদিন 
সযত্নে লুকিয়ে রাখা আপাদমস্তক



মে সংখ্যা || আলাপচারিতায় সুতনু চট্টোপাধ্যায়

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  আলাপচারিতায় সুতনু চট্টোপাধ্যায়

ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী  সুতনু চট্টোপাধ্যায়। জন্ম ১৯৬৮ সালে,বোলপুরে।বিশ্বভারতীর কলাভবন থেকে শিল্পকলার প্রথাগত শিক্ষা শেষ করেন। ভাস্কর্যের স্নাতক(১৯৯৫) ও স্নাতকোত্তর(১৯৯৭) উত্তীর্ণ  হন প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে। বর্তমানে কলাভবন ভাস্কর্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান  সুতনু চট্টোপাধ্যায় ভাস্কর্যের  অবদানের জন্য জাতীয়  ও রাজ্যস্তরে বহু পুরস্কারও পেয়েছেন।।তাঁর ভাস্কর্য ও ছবি দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শিত। শিল্পের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রবন্ধও লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও জার্নালে।
মল্ল সাহিত্যের পক্ষ থেকে  ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী সুতনু চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথায় কথায় তাঁর জীবন ও শিল্পচেতনার কথা ভাগ করে নিলাম পাঠকদের সঙ্গে ।



মন্দিরাঃ  জন্মের পর বেড়ে উঠতে উঠতে সবার মাঝে নিজেকে কখন আলাদা মনে হলো? জীবনের ভিতরেও অন্য কোনো জীবনের টান কি সচেতনভাবেই এসেছিল?

সুতনুঃ প্রথমত বলা দরকার আমার জন্ম বোলপুরে মামারবাড়িতে হলেও পৈত্রিক বাড়ি অজয়ের ওপারে বর্ধমান জেলার রামনগর মল্লিকপুরে। গ্রাম্য সরস জীবনের প্রভাবে আমার বেড়ে ওঠা। গ্রামের উৎসব,পালাপার্বণ শিশুমনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। কীর্তন কবিগান লোটো,ভাদু গান, মনসার গানে মজে থাকত শৈশব। কালীপুজোর নাটক দেখার জন্য সারা বছরের প্রতীক্ষা যেমন ছিল, তেমনি সেই স্টেজে বা প্রয়োজনে ব্যাকড্রপ থেকে গান গাওয়ার উত্তেজনা ছিল প্রবল। তবে এই এতসব আয়োজনের মাঝে  নীলকন্ঠ মিস্ত্রির ঠাকুর গড়ার  সময়টা ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণের। অঘ্রাণ মাসে নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে আমাদের বাড়িতে তিন পুরুষের গৃহদেবী অন্নপূর্ণার মূর্তি গড়তে প্রতিবছর কাটোয়া থেকে  নীলকণ্ঠ মিস্ত্রি আসতো। খড়ের কাঠামো থেকে মূর্তির  রং পর্যন্ত  প্রতিটি পর্ব খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতাম আর সারাবছর সেইসব করণকৌশল নিজের মূর্তি গড়ার কাজে প্রয়োগ করতাম। পাশাপাশি চলতো ছবি আঁকার চর্চা।নিজের খুশিমতো যা ইচ্ছে আঁকতাম। কখনো কপি করতাম। স্কুল থেকে ফিরে বা ছুটির দিনে কুমরপাড়া থেকে মাটি  এনে যে প্রতিমা বানাতাম, প্রতি সন্ধ্যায় বিসর্জন দিতাম ঘটা করে টিন বাজিয়ে। এছাড়া মাছধরা থেকে থেকে ফুটবল ক্রিকেট খেলা তো ছিলই। গ্রামের অদূরেই পান্ডুরাজার ডিপি অসম্পূর্ণ খননকার্য করা পাথরের ভগ্ন মহল। ইতিহাস থমকে আছে সেখানে। বড় বিস্ময় বোধ হতো। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবনা শুরু হয় সেখান থেকেই।  ছোটবেলা থেকেই ছিলাম শান্ত ও ভাবুক। এই জগৎ সংসার বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কিছুই যদি না থাকতো  তবে কেমন হতো! আমি-র অস্তিত্ব নিয়ে সংকট সেখান থেকেই। খেলতে খেলতে সামান্য বিশ্রামের অবকাশে বসে ভাবতাম একটা কিছু আমাকে করতে হবে,  নতুন কিছু। সবকিছু থেকেও মনের মধ্যে একটা দুঃখবোধ, একটা অপ্রাপ্তির হতাশা বা কান্না আমাকে গ্রাস করতো। সেখান থেকেই সবার মাঝে নিজেকে কিছুটা আলাদা মনে হতো। 
স্কুলের পাঠ শেষ হতে না হতেই মনে হতে লাগলো শুধুই পরীক্ষা পাস, মুখস্থ, এর থেকে  মুক্তির উপায় কী যা আমার মনকে আনন্দ দেবে? গান গাইছি, ছবি আঁকছি, মূর্তি গড়ছি আবার কঠিন বাস্তবকে প্রত্যক্ষ করছি প্রতিদিন। এভাবেই জীবনের ভেতরে অন্য কোনো জীবনের টান অনুভব করলাম। পথ চলছি, চলতে চলতে পড়ে  গিয়ে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছি। সৃষ্টিশীল মন ক্রমশ জাগ্রত হচ্ছে, সতেজ হচ্ছে।আমাকে ঠিক পথে চালনা করবেন এমন গুরুর দর্শন পাচ্ছি না। এমন সময় শিল্পী সুহাস রায় আমার আঁকা ছবি দেখে বললেন, "তোমার শিল্প দৃষ্টি আছে, কাজ করে যাও।" তাতে উৎসাহ পেলাম।

মন্দিরাঃ শিল্প চেতনা এবং বাস্তব চাহিদার মধ্যে দ্বৈরথ ছিল কোনো?

সুতনুঃ সাধারণ মধ্যবিত্তের যা চাহিদা থাকে পড়াশোনা শেষে একটা চাকরি -এর বেশি কিছু না। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই ছিল। সঠিক পথ দেখানোর কেউ ছিলনা।প্রথাগত  জীবনধর্ম থেকে সরে গেলাম হোঁচট খেতে খেতে। ভাস্কর্য না ছবি নিয়ে আলাদাভাবে পড়াশোনা করা যায় এমন ধারণা ছিল না প্রথমদিকে। গানের গলা ছিল ছোট থেকেই। ফাংশনে বা লোকের বাড়িতে গাইলে  প্রশংসা পেতাম। কিশোরকুমার আদর্শ ছিল। তাঁর মতো গায়ক হতে চেয়েছিলাম এক সময় কিন্তু কীভাবে কোন পথে সেখানে যাওয়া যায় তার হদিশ পাইনি।ভাবতাম গান না শিল্প,নাকি দুটোই সঙ্গী হবে সেসব নিয়ে প্রচুর ভাবনাচিন্তা চলত। আর্ট কলেজে প্রবেশাধিকার পেলাম বহু পরিশ্রমের পর। শিল্পী সনৎ কর বলতেন 'শুধুই ছবি আঁকলে বা মূর্তি গড়লেই হবে না, সঙ্গে উপযুক্ত পড়াশোনা করা প্রয়োজন'। তবে কলাভবনে ছাত্র হয়ে আসার অনেক আগেই আমার শিল্পী মনে বেশ কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে ছিলাম। রামকিঙ্করের স্নেহধন্য বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী- সৌমেন অধিকারী যিনি আমার ছোটখাটো ভাস্কর্য দেখে উৎসাহ দিতেন, যেগুলো ওঁর বাড়িতে বসেই করতাম। রামকিঙ্করের কথা শুনতাম তাঁর মুখে। শুধু খাওয়া-পরার বাইরেও যে একটা জীবন আছে, তা বুঝতে পারলাম আস্তে আস্তে- কিছুটা নন্দলালের লেখা পড়ে। বিনোদ বিহারী-র 'চিত্রকর' পড়ে মুগ্ধ হতাম। রামকিঙ্করের সাক্ষাৎকার গুলো বার বার পড়তাম আর বহু জিজ্ঞাসার উত্তর পেতাম। অবনীন্দ্রনাথের বাগেশ্বরী বক্তৃতার ক্ষুদ্র  সংস্করণ 'শিল্পায়ন' এর লেখাগুলো পড়ে মুগ্ধ হতাম। এসব পড়ে নিজেকে তৈরি করতাম, মনকে একমুখী করতাম। শিল্পী হতে গেলে শিল্পীমন তৈরি করাটা অত্যন্ত জরুরী।মধ্যবিত্ত গৃহস্থের একমাত্র পুত্রসন্তান ছিলাম   বলে একটা প্রবল চাপ ছিল পারিপার্শ্বিকের। সবকিছুর মধ্যে থেকেও নিজের ভেতরে একটা অন্য জগৎ তৈরি  করতে হয়েছিল,শিল্পের প্রতি অদম্য তাগিদ আর নিজেকে প্রমাণ করার জন্য।আমার মনে হয় একজন ভাস্কর হতে গেলে  তাঁকে গৃহসুখ অনেকটাই ত্যাগ করতে হয়। শিল্পকর্মে সময় দিতে হয় অনেক বেশি।

মন্দিরাঃ ভাস্কর্য না রংতুলি... এই দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব  ছিল কি?না দুটোই সমান আকর্ষণের? 

সুতনুঃ তিনদশক কাজ করার পর এখন মনে হয় দুটোই সমান। এখন কোনো দ্বন্দ্ব নেই, কিন্তু তখন ছিল। তখন আমার মনে হতো আমি ছবি ভালো আঁকতে পারি না। আমার ভাস্কর্যের পাশে আমার ছবি অনেক দুর্বল মনে হতো। এক বিখ্যাত মাষ্টারমশাই আমাকে পেইন্টিং নিয়ে পড়তে বলেছিলেন। আমি তাঁর কথা উপেক্ষা করে ভাস্কর হতে চেয়েছিলাম। কারণ আমার মনে হয়েছিল ভাস্কর হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে সুবিধা হবে। কারণ নিজের দক্ষতা সম্পর্কে আমি ছিলাম শ্রদ্ধাশীল। মাটিতে হাত দিলে আর পাঁচজনের থেকে ভালো কাজ করবো এই বিশ্বাস আমার ছিল। পাস করার পরেও ড্রইং করতাম প্রচুর। যেখান থেকে আস্তে আস্তে আমার ছবির জায়গাটাও ক্রমশ মজবুত হলো। ২০১৭ সাল থেকে ক্যানভাসে ছবি আঁকি ভাস্কর্যের পাশাপাশি নিয়ম করে। এখন পেইন্টিংয়েও নিজের ভাবনাকে রূপ দিতে পারি এবং অনেক ক্ষেত্রেই সফল হই। এখন ভাস্কর্য ও ছবি দুটোই আমার কাছে সমান আকর্ষণের। 

মন্দিরাঃ বিশ্বভারতীর  মতো নামী প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাওয়ার মধ্যে যুদ্ধ কতখানি?পরিবারের সহযোগিতা ছিল নিশ্চয়ই! 

সুতনুঃ ১৯৯০ সালে আমি কলাভবনে পড়ার সুযোগ পাই। তার আগে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পাইনি। ওই হাজার দু'য়েক ছেলেমেয়ের মধ্যে মাত্র কুড়ি পঁচিশ জনকে নির্বাচন করা হতো প্রতিবার এবং এখনকার মতো ভাস্কর্যের জন্য আলাদা করে  কোনো টেস্ট নেওয়া হতো না। সবাইকেই পেন্টিং-এ টেস্ট দিয়ে ঢুকতে হতো। তাই সুযোগ পাওয়াটা ছিল খুবই কঠিন। তারমধ্যে নানা রকম কোটা তো তখনও ছিল। আর ১৯৯০ সালের আগে পর্যন্ত ডে-স্কলারদের জন্য আলাদা করে কোনো কোটা ছিল না। স্থানীয় ছেলেমেয়েরা তাই  কলাভবনে পড়ার সুযোগ থেকে কিছুটা বঞ্চিত হতো।  অসীন দাশগুপ্ত উপাচার্য হয়ে এসে ডে-স্কলারদের জন্য দুটি সিট(কোটা) চালু করেন। বারবার বিফল হতে হতে মনের মধ্যে অদম্য একটা জেদ তৈরি হয়। ফলে নিজের চর্চার জায়গাটা বেশ কিছুটা মজবুত হয়। একটা ভালো শিল্পকর্ম করার জন্য যে পরিমাণ শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করতে হয়, বা শিল্পী হওয়ার লক্ষ্যে যে  পরিমাণ প্রস্তুতি দরকার এবং সেটা যদি উৎকৃষ্ট মানের হয় তো সেটা যুদ্ধের সামিল। সেই অর্থে আমার কোন শিক্ষক ছিল না, তাই নিজেই চেষ্টা করতাম নিজের মত  করে। সেই কারণেই হয়তো কলাভবনে প্রবেশাধিকার পেতে সময় লেগেছে। 
পারিবারিক সহযোগিতা একটা ছিল।যখন সিদ্ধান্ত নিলাম কলাভবনে ভর্তি হব, শিল্পী হতে চাই, তখন কেউ আমাকে বাধা দেননি। পরে কিছু কিছু স্বীকৃতি, পুরস্কার যখন পেলাম তখন সবার একটু একটু বিশ্বাস হতে থাকলো যে কিছু হলেও হতে পারে। মনে আছে আমার প্রথম একক প্রদর্শনীর সময় বাবা আমাকে কুড়ি হাজার টাকা দিয়েছিলেন প্রদর্শনীর খরচ-খরচা বাবদ। 

মন্দিরাঃ কলাভবনে ছাত্রাবস্থায় কাদের ছবি এবং ভাস্কর্য বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে...

সুতনুঃ আমার মাস্টারমশাইরা প্রত্যেকেই এক একজন দিকপাল ভাস্কর ছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকের কাজেরই নিজস্ব একটা চরিত্র ছিল।কাজেই এঁদের কথাবার্তা ও দর্শন ছিল ভিন্ন। এঁদের শিক্ষাদানের পদ্ধতিটা ছিল নিজস্ব। যার ফলে আমরা খুব বৈচিত্র্য অনুভব করতাম সব সময়। প্রায় প্রত্যেকেরই উচ্চশিক্ষা বিদেশে। ভাস্কর অজিত চক্রবর্তী, ভাস্কর শর্বরী রায় চৌধুরী, ভাস্কর বিপিন গোস্বামী, ভাস্কর সুষেণ ঘোষ, ভাস্কর বিকাশ দেবনাথ-এঁরা ছিলেন আমার মাস্টার মশাই। এঁদের ভাস্কর্য দেখে মুগ্ধ হতাম। চোখের সামনে কখনো কখনো কাজ করতেও দেখতাম। শান্তিনিকেতনের উদার প্রকৃতি চোখ মেলে দেখতাম। লাইব্রেরীতে গিয়ে সারা বিশ্বের ভাস্কর্যের বইগুলো মন দিয়ে দেখতাম। আর শান্তিনিকেতন জুড়ে যার ভাস্কর্য ছড়িয়ে আছে সেই রামকিঙ্করের ভাস্কর্য ঘুরতে ফিরতে সব সময় চোখে পড়তো। সত্যি বলতে কি এই রামকিঙ্করের ভাস্কর্য আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে। তাঁর সাক্ষাৎকারগুলো মন দিয়ে পড়তাম। সেখান থেকে অনেক কিছুই পেয়েছি। প্রভাব তো আসবেই। আর ছবির ক্ষেত্রে বলতে পারি ভ্যান গঘ, পিকাসো ও রামকিঙ্কর আমার প্রিয় ছিল। 

মন্দিরাঃ আপনার ভাস্কর্য দেশে বিদেশে প্রভূত  প্রচার এবং সম্মান পেয়েছে। সে সম্পর্কে কিছু বলুন।

সুতনুঃ ২০১০ সালে সিঙ্গাপুরে একটি মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য করার আমন্ত্রণ পাই। ভাস্কর্যটি ব্রোঞ্জে করেছিলাম। ওই দেশের একটি বিখ্যাত গ্যালারিতে আমার দুটি ভাস্কর্য সংগৃহীত হয়েছে। এছাড়াও এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত সংগ্রহে আমার বেশ কিছু ছবি ও ভাস্কর্য আছে। ব্যাংককের শিল্পকর্ণ ইউনিভার্সিটিতে আমার দুটি ভাস্কর্য আছে। সেখানে দুবার গিয়ে একটি করে ভাস্কর্য করে এসেছি। ২০১৯ সালে সেখানে এক আন্তর্জাতিক কর্মশালায় সারা বিশ্বের সেরামিক আর্টিস্টদের সাথে একসঙ্গে কাজ করার  সুযোগ হয়। বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের সাথে ভাবনা-চিন্তার আদান-প্রদান হয়। সেখানে একটি প্রমাণ সাইজের সেরামিক ভাস্কর্য করেছিলাম যেটা মুক্তাঙ্গনে প্রদর্শিত আছে। সেখানকার একটি মিউজিয়ামে আমার দুটি টেরাকোটা ভাস্কর্য সংগৃহীত হয়েছে। এছাড়া জাপান,রাশিয়া প্রভৃতি দেশের কিছু মানুষ বিভিন্ন সময়ে আমার ভাস্কর্য সংগ্রহ করেছেন। সম্প্রতি কোরিয়াতে একটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে আমার কাজ প্রদর্শিত হয়েছে। 
সেই অর্থে প্রভূত প্রচার না পেলেও আমার কাজ অনেকেই ভালোবেসেছেন। দু-একটি দেশে আমন্ত্রণ পেয়েছি বলা যায়। ২০১৬ সালে ইউরোপের তিনটি দেশের সেরা মিউজিয়াম ও কিছু গ্যালারি ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল যা আমার ভেতরে শিল্পকর্মের খিদে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। চার- পাঁচটা  আন্তর্জাতিক কর্মশালায় কাজ করার সুবাদে বিশ্বের নানা দেশের বেশ কিছু শিল্পীর সাথে ভাবের আদান-প্রদান সম্ভব হয়। 

 মন্দিরাঃ সাহিত্য এবং শিল্প... দুটোর মধ্যে মিল বা অমিল কোথায়?

সুতনুঃ শিল্প ও সাহিত্য এ দুটি জীবন থেকে উদ্ভূত। মানুষের অভিজ্ঞতার জগতই শিল্প-সাহিত্যের অবলম্বন। শিল্প ও সাহিত্য ভাবের বিষয়, জ্ঞানের বিষয় নয়। উভয়েরই উদ্দেশ্য রস সৃষ্টি। 
 দর্শনের সত্য শিল্পের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেতে পারে।সাহিত্যেও  অনুরূপ  বলা চলে।তবে সাহিত্যে বর্ণনা  অনেক বেশি।শিল্পেও বর্ণনার সুযোগ  আছে,তবে উন্নত শিল্পে বর্ণনা কম। সাহিত্য জীবনের অনুকরণ, কিন্তু শিল্প জীবনের অনুভব। শিল্পের ভাষা আন্তর্জাতিক। একটা  কাক আঁকলে সব দেশের মানুষই সেটা বুঝতে পারে।

মন্দিরাঃ আপনার কি মনে হয় না ছবি বা ভাস্কর্যও  একধরনের  কবিতা!শুধু মাধ্যমটি আলাদা?

সুতনুঃ কাব্যে রূপের চেয়ে ভাব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কবিতা লেখার সময় প্রথমে আসে রসের উপলব্ধি। তারপর রূপ। রস দিতে হলে রূপ দিতে হয়। রূপ না দিলে রস দেওয়া হয় না। অন্তরের রস অন্তরেই আবদ্ধ থাকে। মুক্তি পায় না।শিল্পীর মুক্তি হয় রসের মুক্তিতে। আর রসের মুক্তি ঘটে রূপের সৃষ্টির ফলে। এখানে সৃষ্টি হল রূপসৃষ্টি -কবিতারূপ,কাহিনিরূপ, চিত্ররূপ, ভাস্কর্যরূপ, নৃত্যরূপ। এবার তুমি যা বোঝার বুঝে নাও। 

মন্দিরাঃ ভাস্কর্যের বা ছবির বিমূর্ততার সঙ্গে কবিতার বিমূর্ততার কোথাও যেন অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ.....আপনার ভাবনায় কী বলে?

সুতনুঃ আপনার প্রশ্নের মধ্যেই আমার উত্তরের একটা ইঙ্গিত আছে। বিমূর্ততার ধরণটা ভাস্কর্য, ছবি ও কবিতার ক্ষেত্রে প্রায় এক। উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা রূপ থেকে অরূপে যাচ্ছে। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে বিমূর্ততারও  একটা আকার আছে, ছবিতে ও তাই, কবিতাতে সেটা অদৃশ্য অবয়ব।

মন্দিরাঃ চেষ্টা  করেছেন কখনো ভাবনাকে রং তুলি নয়,পাথর বা মাটি নয়,অক্ষরে প্রকাশ করার?

সুতনুঃ নিশ্চয়ই। যে কোনো মাধ্যমে নিজেকে নানাভাবে প্রকাশ করতে চাই তাই সময় সুযোগ হলেই আমি লিখি। সেটা বিশেষ বিশেষ দিনে ডায়েরিতে বা খসড়া খাতায় লিখে রাখি- মনের যত ভাবনা, সেটা শিল্প-চিন্তা হতে পারে, শিল্পের কোনো বিশেষ দিক হতে পারে। যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি,এমন সব শিল্পীদের জীবন ও তাঁদের শিল্পকর্ম নিয়েই আমার লেখালিখি। আবার কখনো কোনো বিখ্যাত শিল্পীর অনালোচিত কোনো বিশেষ দিক নিয়ে আমার সন্ধান।লেখার মধ্যেও  আমি অনাবিল আনন্দ পাই।

মন্দিরাঃ এত বড় দপ্তরের গুরু দায়িত্ব সামলে নিজের সৃষ্টিতে  কতখানি সময় দিতে পারেন?

সুতনুঃ বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব সামলে শিল্পকর্ম করাটা একটা  চ্যালেঞ্জ। নিজের সৃষ্টিতে যে পরিমাণ সময় দিতে পারলে ভালো হয়  সেটা দেওয়াটা মুশকিল হয়। তবে চেষ্টা করি প্রতিদিন সন্ধ্যে থেকে রাত পর্যন্ত ও ছুটির দুটো দিন নিজের সৃষ্টির কাজে বুঁদ থাকতে। প্রতিদিন তিন-চার ঘন্টা নিজের কাজের সঙ্গে কাটাই।আর সেটাই মনের মুক্তির একমাত্র পথ। 

মন্দিরাঃ সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য কাজ বা কর্মশালা কী চলছে অল্প কথায় বলুন।

সুতনুঃ সম্প্রতি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে যৌথ ভাবে কলাভবন ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্রদের নিয়ে পাঁচটি পরিবেশগত ভাস্কর্যের একটি বিরাট কর্মশালা পরিচালনা করছি।পরিবেশ থেকেই উপাদান নিয়ে পরিবেশগত ভাস্কর্য সৃষ্টির এমন উদাহরণ আমাদের দেশে বিরল।মৃত গাছপালা ও তার ডালপালা দিয়ে তৈরি এই ধরণের কর্মশালা কলকাতায় ইতিপূর্বে হয়নি।

মন্দিরাঃ সব শেষে এই আন্তর্জালের মাধ্যমে শিল্প ও সাহিত্যের সার্বিক প্রচার ও প্রসার কি সম্ভব! আপনি সমর্থন  করেন?

সুতনুঃ আমার তো মনে হয় সম্ভব। তাই আমরা এখন নিজের শিল্পকর্মের একটা ওয়েবসাইট বানাই, যা সারা বিশ্বের মানুষ ঘরে বসে দেখতে পারেন। অনলাইনে প্রদর্শনী, ওয়ার্কশপ, টকশো ও ওয়েবিনার করি। এতে প্রচার ও প্রসার কিছুটা হয় বৈকি। তবে প্রদর্শনীতে গিয়ে ভাস্কর্য ও ছবি দেখার যে আনন্দ সেটা এখানে পাওয়া যাবে না। 

মন্দিরাঃ মল্ল সাহিত্যের পক্ষ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান ভাবনা পাঠকদের সঙ্গে বিনিময় করার জন্য।ভালো থাকবেন। সৃজনে থাকবেন।

সুতনুঃ মল্ল সাহিত্যকেও আমার আন্তরিক ধন্যবাদ।



মে সংখ্যা || কবিতায় সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায় 


অনুরণন

অথচ , তুমি পুরোপুরি ভুলে গেছো আমাকে 
যেভাবে ডুবে যাওয়া নৌকাকে ভুলে যায় সমুদ্রের জল 
এবং তুমিও আজ স্মৃতি-বিস্মৃতির মতই অপ্রাসঙ্গিক 
তবু এই ঝুপ করে নেমে আসা হেমন্তের সন্ধ্যায় 
দিগন্ত-কুয়াশায় আচমকা জ্বলে ওঠে বনফায়ার 
হাজারিবাগের  জঙ্গলে আগুনের চারপাশে ভেসে ওঠে মুখ 
ছাতিমের গন্ধমাখা পথঘাটে আলগোছে ফিরে আসে প্রত্ন-অসুখ 
"অনুরণন" শব্দের অর্থ এ শহরে কেউ জানে কি না -
ভাবতে ভাবতে আজ বহুকাল পর  
আমি এক আনমনা ট্রামে উঠে পড়ি ....


মে সংখ্যা || কবিতায় তাজিমুর রহমান

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  তাজিমুর রহমান 



মাল্যদান পর্ব



একটা বিপন্নতা ঝুঁকে রয়েছে দরজায়, সদরে!

চৌকাঠ ছাড়ালে মেঘেদের কলরব,শিবির বদলের ছৌ-গাথা

অথচ সীমান্ত এলে সব পারাপার নিধুবাবুর টপ্পা


শুধু কার্তিকে সকলে ঘরে ফিরে এলে

ধানের শিষের উপর আজও

জীবনানন্দ রোদ বুনে দেয় প্রিয় চড়ুইয়ের দল;

তবু বাসি অক্ষর থেকে খুঁটে খুঁটে সাজিয়ে রাখি

গোধূলির নিভৃত হেমন্তশোক


নিখুঁত বিপন্নতাও তখন আর এক বিপন্ন বোধ থেকে

শুরু করে দেয় অগস্ত্যযাত্রা

ছন্দহীন পড়ে থাকে পৌরমানব আর মাল্যদান পর্ব



মে সংখ্যা || কবিতায় দীধিতি চক্রবর্তী

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||   দীধিতি চক্রবর্তী 



জানতাম

তুমি বলেছিলে প্রেম, 
ওরা বলেছিল দেহ, 
সে বলেছিল ভোগ, 
আমি জানতাম মোহ। 

তুমি বলেছিলে চোখ, 
ওরা বলেছিল বুক, 
সে বলেছিল থাই, 
আমি জানতাম সুখ।

তুমি বলেছিলে টান, 
ওরা বলেছিল ঝোঁক, 
সে বলেছিল খিদে, 
আমি জানতাম শোক।



মে সংখ্যা || কবিতায় সুদীপ্ত ভট্টাচার্য

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  সুদীপ্ত ভট্টাচার্য


যাপনকথা

বারান্দা থেকে উঠোন গোবর নিকানো হতো রোজ
মা পইপই করে বলে দিতো
খবরদার যেন পা দিবি না,
পিছল খেয়ে পড়লে আর রক্ষে নেই।

পা বড় হয়ে গেলে পথ গিলে খেতে চায় মানুষকে
এসব বৃত্তান্ত মা অনেক আগেই জানতো
যদিও আমাদের সকলের পা ধীরে ধীরে নদীর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলো,
সারাদিন রোদ্দুর জড়ো করে বাবা যতোটা আলো নিয়ে আসতে চাইতো
আঙ্গুলের ফাঁক গলে তার বেশ খানিকটা পিছল খেয়ে ছড়িয়ে যেত পথে
সেই পথেই গড়ে উঠেছিল বাজার দোকান পাঠশাল,

আমি ডুবন্ত সূর্যের দিকে ছুটে যেতাম
মা বলতো, খোকা! পিছল খেয়ে পড়ে যাবি!
পথ চিনতে অনেক বাকি তোর
আর আমি! অস্ফুটে ভাঙা সিঁড়ির দেউড় পেরিয়ে বলতাম
কোনদিন সোনাগলা গোধূলির কিছুটা পেলে
তোমার দু'হাতে দু'গাছা চুড়ি গড়িয়ে দেবো...

এর ও অনেক পরে বাবা চৌকাঠ পার হতো সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে...


মে সংখ্যা || অণুগল্পে ফাল্গুনী দে

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  ফাল্গুনী দে


বনমালী 


টেলিগ্রাম পেয়েই স্বর্গ থেকে ব্যোমকেশ নেমে এলেন শান্তিনিকেতনে। নোবেল চুরির অনুসন্ধান নয়; এক মায়াবৃক্ষের রহস্য উন্মোচনে। নন্দনকাননে নেই এমন গাছ পৃথিবীতে কোত্থেকে এলো? তিনি নিজেও খানিকটা অবাক কিন্তু সংযত। পরদিন সাতসকালে বাগানের মালী ভানু সিং-এর সাথে বেরোলেন প্রাতভ্রমণে। আলো-আঁধারি সেই চরাচর লক্ষ কোটি জোনাকি আবৃত। সামনে এসে দাঁড়ালেন। অনুভবের সাতটি রঙ সাতটি ফুলে বর্ণময় এক বোধিবৃক্ষ -- যেন ইন্দ্রধনু। একটিকে স্পর্শ করতেই দেহমনে প্রেম জেগে ওঠে; অন্যটির দিকে তাকালে যেন পূজার অঞ্জলি; পাশেই পান্না রঙা ঋতু-প্রকৃতি; আরেকটি ওই নিচে -- বিচিত্র তার প্রকাশ; ওপাশে স্বদেশের গরিমা চুঁইয়ে পড়ছে; গোড়ায় আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন। আচমকা, হাওয়ার দোলায় ফুলগুলি সুরে সুরে বেজে উঠলো। গোয়েন্দা হতবাক। ভানুকে দিলেন মাটি খোঁড়ার নির্দেশ। উঠে এলো জলজ্যান্ত পাণ্ডুলিপি গীতবিতান। গোয়েন্দা আপ্লুত। মালী ভাবলেশহীন। বললে - "ও তুই নিয়ে যা, আমি মরে গেলে এর অপব্যবহার হবে।"


মে সংখ্যা || কবিতায় অমিত গোলুই

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||    অমিত গোলুই 



বনসাই 

নিজেকে বড়ো করে 
অন্যকে ছোট দেখতে দেখতে 
ভুলেই গেছি 
নিজেকে ছোট করে 
অন্যকে বড়ো দেখতেও
কতো ভালো লাগে  । 


ভাস্কর্য 

পরিত্যক্ত গাছের গুঁড়ি তুলে এনে 
শিল্পী সুন্দর মানুষের মুখ গড়ে 
সৃষ্টির আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল । 

আর পরিত্যক্ত গাছের গুঁড়ি , সে কী পেল ? 

সে পেল আবর্জনা থেকে উঠে এসে 
শিল্পীর স্টুডিয়োতে আশ্রয়
আর শরীর জুড়ে ছেনির আঘাত 
সইতে সইতে টের পেল
এক আবর্জনা থেকে উঠে এসে 
আর এক আবর্জনায় ঢেকে গেল । 


মে সংখ্যা || কবিতায় শ্রীপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায়

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||   শ্রীপর্ণা গঙ্গোপাধ্যায় 



জলশঙ্খ

একবার এক নদী আমায়  বলেছিল,
 তোমার হাত খালি রেখো
ফিরে এসে তোমার হাতের পাতায়
একটি নতুন নাম দেব।
আমি আমার শূন্য হাতের পাতা দেখি আর শুনি
জলশঙ্খের ডাক।  
কোন পথে যে সে আসবে  ঠিক 
বুঝতে পারি না। 



মে সংখ্যা || কবিতায় তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায় 


মৃত্যু

আশ্চর্য কপিশ মৃত্যু আমাদের নয়, যার চিরায়ত ছায়া
শরণাগত-র মুখে চিৎ হয়ে শোয়। যেন নিসর্গ এমন
ঘটনার হিম থেকে বহু দূরে রেখেছিল জন্মঘোর, মায়া—
সেহেতু যে-কোনও মৃত্যু তুখোড় জান্তব আর লাগে না তেমন।

শমীবৃক্ষ আমাদের অস্ত্রগুলি পুনরায় অস্বীকার করে।
কোনও গুহামুখ নেই, সমস্ত আশ্রয় থেকে মায়া দোহনের
শব্দ উঠে আসে; স্তন ক্রমশ শিথিল, উষ্ণ প্রাতিস্বিক জ্বরে।
সুতরাং খাদ্য নেই, স্রোত নেই। আয়ু নেই শোক মন্থনের।

নিক্ষিপ্ত হয়েছে কার ত্বাষ্ট্র? দ্যাখো, যত স্মৃতি ছিল জাগরূক,
সমস্ত অতল খাদে ক্রমশ তলিয়ে গেল। এখন কে কার 
মুখাগ্নি সাজাবে? খই মোহের আরক; পথে হরিধ্বনি ঝরে।

আশ্চর্য কপিশ মৃত্যু আমাদের নয়, তবু অগরুর সুখ
আত্মীয়হনন ছুঁয়ে ফণা তোলে। শমীবৃক্ষ বিকল সেতার।
এখন সমস্ত সুর তামসিক। জেগে আছে শবের শিয়রে...