Tuesday 8 October 2024

শারদীয় সংখ্যা ১৪৩১ || দেবব্রত রায়

 



অনিমেষ মিত্তিরের শরীরে জিরোদের চাকরি পাওয়া চামড়া 
দেবব্রত রায় 

জেলফেরত অনিমেষ মিত্তির সবসময় হাতে কুয়ো-দড়ির মতো একগাছা দড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ! সবসময়, বলতে যতক্ষণ তাকে রাস্তায়ঘাটে দেখা যায় আর-কি ! কারোর বাড়ির ভিতরে তো আর উঁকিঝুঁকি মেরে দেখা যায় না !  সেটা মানুষের ভদ্রতায় ঠেকে। 
অনিমেষ নিজে অবশ্য, তার সাতজন্মেও এসব ভদ্রতাটদ্রতার ধার ধারত না। দিনেদুপুরে ছেলেমেয়ে, মা-বোনের সামনেই বউকে বিছানায় টেনে নিয়ে গিয়ে তার শায়ার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে  সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলত, আমার কাছে বেশি সতীগিরি মারাতে এসো না ! মেয়েদের ভগায় জল গড়ালেই, সব ছেনাল-মাগী হয়ে যায় !  
অনিমেষের একসময়কার বুজুম ফ্রেন্ড পরেশ ঘোষ মাঝে-মাঝেই আমাদের ঠেকে আসতেন। আমরা সিগারেট ফুকতাম। পরেশ ঘোষ পকেটে করে ডেটলের শিশির মতো একটা ছোট কনটেনারে ভরে ষাট-এমএল-এর মতো হুইস্কি নিয়ে আসতেন। কথার ফাঁকে-ফাঁকে সেটার থেকে দু-এক সিপ করে নিতেন। আমাদের ঠেকে একমাত্র, ল্যাংড়া মোফিদেরই গাঁজার নেশা ছিল। তাও আবার, লাল শালু দিয়ে মোড়া কল্কেতে ভরে ! পরেশ ঘোষের সেন্স অফ হিউমার ছিল মারাত্মক ! একটু নেশা হলেই, তিনি শান্তি-জলের মতন, অনিমেষ মিত্তিরের যত কেচ্ছা-কাহিনী, সব দরাজ-হাতে আমাদের উপর ছেটাতে শুরু করতেন ! আর মাঝে-মধ্যে ল্যাংড়া মোফিদকে রাগানোর জন্য হাতের কনটেনারটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলতেন, ভায়া, ধোঁয়ায় একটু জল মেশাও ! না-হলে ঘরময় ওড়াউড়ি করছে যে ! মোফিদ কল্কেতে দু-টান দিলেই নিজেকে জাক দেরিদা মনে করত ! সে বলত," উঁহু, মোটেই জল দেওয়া যাবে না। আমি চাই ধোঁয়াগুলো সব মেঘদূত হয়ে উড়ে যাক ! ওরা রিম্পিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুক, ইজ সি লাভ মি অর নট ?  " ইঞ্জিনিয়ারিং-কলেজের এক ক্লাস জুনিয়র রিম্পি ছিল মোফিদের হার্টথ্রব ! কিন্তু মোফিদ তার হার্টথ্রব ছিল কিনা, সেটা বোধহয়, ওর জানা ছিল না ! একদিন শিলিগুড়ি মার্কেটে প্রেম নিবেদন করতে যেতেই, রিম্পি তার হাই-হিল জুতো খুলে মোফিদকে তাড়া করেছিল ! সে রাতেই মফিদ লুকিয়ে মেয়েদের হোস্টেলের ছাদে উঠে শোলের বীরুর মতো, সেখান থেকে " গুড বাই! গুড বাই! " বলে , সত্যি-সত্যিই ঝাপ দিয়েছিল ! ওর সেই গুডবাই-যাত্রায় কোনোক্রমে সেবার প্রাণে বেঁচে গেলেও, মোফিদের একটা পা অ্যাম্পুট করতে হয়েছিল ! তারপর সুস্থ হয়ে কলকাতায় ফিরে সেই যে আমাদের ঠেকে এসে ঢুকেছিল, আর বেরোয়নি ! হাজরা-মোড়ের যে উদুক্ষুলে মেসটাতে আমরা থাকি, সেখানে মোফিদেরও একটা বেড রাখা ছিল। সারাদিন সেটাতেই ও মড়ার মতন পড়ে থাকত ! আর রাত হলেই তার যত বিত্তাপ বাড়ত ! 
আমাদের ঠেকে আলোচনার কোনো পিতৃদেব-মাতৃদেব ছিল না ! যে যা পারত তাই নিয়েই চিৎকার-চেচামেচির একটা রেনেসাঁ আরম্ভ করে  দিত ! কবি তৌসিফ বিলাল কখনো-সখনো আমাদের আড্ডায় এসে হাজির হতেন। তিনি আমাদের ঠেকটার নাম দিয়েছিলেন, বাস্টার্ডস ব্যাটেল ! 
একদিন কী প্রসঙ্গে যেন অনিমেষ মিত্তিরের কথা উঠতেই, পরেশ ঘোষ বলেছিলেন, " আসলে অনিমেষের চামড়া অনেকটা ওই জিরো-ব্যালেন্সে চাকরি পাওয়া ছোকরা-ছুকরিগুলোর মতন !  লজ্জা-ঘৃণা-অপমান, এসব-কিছুই ও শালার চামড়াকে ছুঁতে পারে না ! অথচ দেখ, দিব্বি হাওয়া থেকে অক্সিজেন নিচ্ছে, রোদ নিচ্ছে, বুক ঠুকে টারজানগিরিও দেখাচ্ছে ! তবে সমস্যাটা কী জান, অনিমেষের ওই চামড়ার জন্যই ওর শরীরের ভিতরে জমে ওঠা বর্জ্যটর্য্যগুলো মোটেই  বেরিয়ে আসতে পারে না !  আর সেটাই হলো যত গণ্ডগোলের কারণ ! পরেশ ঘোষের কথা শুনে তৌসিফ বলেছিলেন , অনিমেষ মিত্তির আসলে, একখানা ত্র্যহস্পর্শ-প্রুফ জিনিস ! 
তৌসিফের এই ত্র্যহস্পর্শ-প্রুফ জিনিসটি নাকি,   এতটাই নোংরা ছিল যে, সদর দরজা হাট করে খোলা আছে দেখেও সে বউকে জড়িয়ে ধরে তার ব্লাউজের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিত। বোন এমনকী, নিজের মেয়েদেরও কথায়-কথায়, বেশ্যা, লোটী বলে খিস্তি মারত ! হাত দিয়ে নোংরা-ইঙ্গিত করে একসময় অনিমেষকে যারা খিস্তিখাস্তা মারতে দেখেছেন , তাঁরা বলতেন, সে-সময় নাকি, অনিমেষকে দেখলে মনেই হতো না, যে ও কোনো কলেজে পড়ায় ! আর এসব কারণেই, অনিমেষের আত্মীয়-স্বজন, কলিগস এমনকী, ওর বন্ধুবান্ধবরাও একেবারে মুখোমুখি না-হয়ে পড়লে সাধারণত, অনিমেষকে আজও এড়িয়েই চলে !  
আদিগঙ্গার ধারে গজিয়ে ওঠা বস্তিটার থেকে বারো ঘরে কাজ করতে আসা নাসপাতি প্রত্যেকদিন বাসবের দোকানের ঝাঁপ বন্ধের আগে ওর ঘুগনির ডেকচি, থালা-বাসন, চায়ের সসপেন-টসপেনগুলো ধোয়াধুয়ি করে দেয়। আর তারপর বাসবের সঙ্গে তার ইস্পেশাল গপ্পেসপ্পোর মাঝে একদিন নাকি, সে বাসবকে বলেছিল, অনিমেষ মিত্তির বিছানাতেও, ওই দড়িটা নিয়েই শোয় ! সে নাকি, দড়িটাকে ধমকে-চমকে বশ মানানোর চেষ্টা করে ! এই কথাটা অবশ্য, অনিমেষ মিত্তিরের বউইয়ের কাছ থেকেই নাসপাতি শুনেছে ! 
 আজকাল অনিমেষ রাতের বেলাতেও ঘরে টিকতে পারে না। ঘরে থাকলেই, তাকে নাকি, কড়িকাঠগুলো ডাকতে শুরু করে ! বলে, আয় অনিমেষ, ঝুলে পড় ! একবার ঝুলে পড়তে পারলেই সব শান্তিই-শান্তি ! 
অনিমেষও ঝুলে পড়তে চায় । কিন্তু পারে না। মরতে ওর খুব ভয় । গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলার দৃশ্যটা মনে করলেই, সে ঘামতে থাকে। ওর হাত-পাগুলো বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে অ্যানাটমির মরা ব্যাং-কে সেলের চার্জ মারলে যেমন কাঁপে, তেমনি কাঁপতে শুরু করে !  
অনিমেষের বউ জয়ন্তী নাকি, অনেকবার দড়িটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে । দু-একবার তো পুড়িয়ে ফেলতেও গেছিল কিন্তু, অনিমেষ জানোয়ারের মতো ওর বউয়ের উপর ঝাপিয়ে পড়ে প্রত্যেকবারই দড়িটা কেড়ে নিয়েছে !  
একদিন বাসবের চায়ের দোকানে হাতের দড়িটা ঝুপ করে নামিয়ে রেখে অনিমেষ মিত্তির হটাৎ-ই, আমার পাশে এসে বসে পড়ে বলেছিল, একটা চা খাওয়াবেন ভাই ! যদিও অনিমেষ মিত্তিরকে আমি খুব-একটা পছন্দ করি না। লোকটা কলেজের লেকচারার ছিল অথচ, বহুবার ওকে ব্লু-ফ্লিম দেখার জন্য সিনেমাহলে ঢুকতে দেখেছি আমি !  তবুও লোকটার উপর কেমন যেন মায়া হলো আজ ! আমি ওর দিকে তাকিয়ে লক্ষ করলাম, অনিমেষ মিত্তিরের চেহারাটা একেবারেই চামচিকের মতো চিমসেপারা হয়ে পড়েছে ! এমনকী ওর কণ্ঠার হাড়গুলোও বাইরের দিকে যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে ! একবার নজর দিতেই মনে হলো, নিঃশ্বাস নিতেও খুব কষ্ট হচ্ছে অনিমেষ মিত্তিরের !  
বললাম, বিস্কুট খাবেন ? কথাটা শোনামাত্রই, অনিমেষ মিত্তির,  " না, বিস্কুট না! বিস্কুট না! গলায় লেগে যাবে! " বলে হটাৎ-ই , এমনভাবে  চিৎকার শুরু করল , আমি তো বটেই , বাসবও এতটাই চমকে উঠেছিল যে ওর হাত থেকে দুটো চায়ের ভাঁড়ই মেঝেতে পড়ে ভেঙেচুড়ে চারদিক একেবারে চায়ে-ভাঁড়ের টুকরোই একাকার হয়ে গেল ! এদিকে অনিমেষ মিত্তিরের তখন দমটম আঁটকিয়ে একেবারে একশা-কাণ্ড ! আমি বাসবকে তাড়াতাড়ি একগ্লাস জল দিতে বললাম। কিন্তু বাসব মেঝে পরিষ্কার করতে করতে অনিমেষের দিকে এমনভাবে তাকাল যে এই দিনে-দুপুরে অন্ধকার নেমে এলেই যেন সে বেঁচে যেত !  আমি বাসবকে একটু ধমক দিয়েই বললাম, " ওর উপর রাগ করে কোনো লাভ আছে ! " দেখলাম তাতেও বাসবের তিরিক্ষি ভাবটা কমল না। তখন বললাম, " ঠিক আছে, আমি তোমার এই চায়ের দাম দিয়ে দেবো। " বাসব আমার কথার কোনো উত্তর না-দিয়ে ভাঁড়ের টুকরোগুলো ডাস্টবিনে ফেলে এসে আগে হাত-পা ধুল তারপর একটা জলভর্তি জগ শব্দ করে আমাদের টেবিলে নামিয়ে রাখল। 
বাসব আবারও ওভেনে চা বসিয়েছে। আমি প্যাকেট থেকে দুটো সিগারেট বের করে একটা নিজে ধরালাম আর একটা অনিমেষ মিত্তিরের দিকে এগিয়ে দিলাম। দেখলাম অনিমেষ মিত্তির সিগারেটটা নিয়ে অর্ধেকটা ভেঙে তার পকেটে রাখল আর অর্ধেকটা ধরিয়ে টানতে লাগল। কিন্তু  সিগারেটের ধোঁয়াটা একবারের জন্যেও গিলল না ! অনিমেষ তার গালের ভিতরে ধোঁয়াটা নিয়ে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ফুক-ফুক করে তা ছাড়তে লাগল ! 
আমার মনের ভিতরে জমে থাকা এতদিনের কৌতুহলটা আর সামলাতে পারলাম না ! জিজ্ঞেস করেই বসলাম। বললাম, আপনি এই দড়িটা নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা ঘুরে বেড়ান কেন ? অনিমেষ বেশ-কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললো, আপনি আমাকে চা-সিগারেটে খাওয়াচ্ছেন মানেই এই নয়, যে আমার প্রাইভেসিতে নাক গলাবার অধিকার পেয়ে গেছেন ! 
ইচ্ছে হলো, লোকটার মাথাটা পাশের দেয়ালে সজোরে ঠুকে দিই ! কিন্তু একটু আগেই বাসবকে জ্ঞান দিয়েছি তাই, ওর অপমানটা হজম করেই চুপচাপ সিগারেট টানতে লাগলাম। বাসব চা দিয়ে গেল, সেই জলের জগ নামানোর মতো শব্দ করেই। অনিমেষ মিত্তির ফু দিয়ে চা ঠাণ্ডা করতে- করতে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, " রাগ করলেন? আসলে নিজের লজ্জার কথা তো তাই, কাউকে বলতে চাই না ! তাছাড়া কথাগুলো বললে কেউ বিশ্বাস করতেও চায় না ! হয়তো আপনিও বিশ্বাস করবেন না, যদি বলি, এই দড়ির ভিতরে আমার বোন নেড়ির আত্মা আছে ! " কথাগুলো বলার মাঝেই অনিমেষের একটা দমকা কাশি উঠল। সে তাড়াতাড়ি জগটার থেকে  কয়েক ঢোক জল খেয়ে একটু দম নিল। তারপর খুব বিষণ্ণ সুরে বললো, এখনো আমি ওকে ভয় দেখায়, নোংরা-নোংরা গালাগাল দিই তবুও, নেড়ি কিছুতেই আমাকে ঝুলতে দিতে চায় না ! বলে, গলায় দড়ি দিলে খুব কষ্ট হয় রে দাদা ! ওরকম করিস না ! " অনিমেষ মিত্তিরের কথাগুলো শুনে সত্যি-সত্যিই আমার হাসি পেল ! কিন্তু এই মুহূর্তে হেসে ফেলাটা অনুচিত কাজ হবে ভেবে গলা পরিষ্কার করার মতো করে কেশে নিয়ে সেটা আটকালাম ! তাতে যে সে কী বুঝল কে জানে ! চা-টা ঢকঢক করে গলায় ঢেলে হটাৎ-ই, দড়িটা হাতে নিয়ে অনিমেষ মিত্তির প্রায় তিন লাফে রাস্তায় নেমেই একেবারে এক-দৌড়ে হাজরার মোড় পার হয়ে গেল ! আমি কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে ঘাড় ঘোরালাম। তারপর চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে-দিতে বললাম, বাসব, নেড়ির কেসটা কী ! 
পরেশ ঘোষ অনিমেষ মিত্তিরের বিষয়ে অনেক গল্পই করেন অথচ, এই নেড়ির ব্যাপারে  কোনোদিন একটা কথাও বলেননি আমাদের। 
বাসব ওভেনটা পরিষ্কার করছিল। বললো, এই শালা অনিমেষ মিত্তির একটা চুতিয়া-বাচ্চা ! বছর দশেক আগে বিএলআরওর একটা দালালকে ঘুষ খাইয়ে ওদের বাপুতে সম্পত্তির সমস্ত রেকর্ডপত্র  থেকেই ওর বোন ওই নেড়ি মানে, স্বপ্নার নামটা বাদ দিয়ে দিয়েছিল ! তারপর আর কি! নেড়ি ওর দাদার এইসব কীর্তিকলাপ জানার পর গলায় দড়ি দিয়েছিল ! একসময় ওদের এলাকার লোকজন ,ওর কাকা-জ্যেঠারা ব্যাপারটা জানতে পেরে থানায় এফআইআর করেছিল ! কিন্তু তাতে কী-আর হলো ! মামুদের ভুঁড়ি তো কিছুতেই আটে না ! হাতে যেমন-যেমন নোট গুঁজবে কেস সেরকম সাজানো হবে !  ফলে ছ-মাস পরেই এই চুতিয়া অনিমেষও বেল পেয়ে গেল! কিন্তু পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না ! দেখছ তো ওর অবস্থাটা ! 

আমি মনে মনে ভাবছিলাম, এর জন্য কি ওর চামড়াটাই দায়ী ! পরেশ ঘোষ বলেছিলেন, ওর চামড়াটা এতই মোটা যে ভিতরের বর্জ্যগুলোও বেরিয়ে আসতে পারে না ! 


2 comments:

  1. সুন্দর লেখা।

    ReplyDelete
  2. অসংখ্য ধন্যবাদ জানবেন

    ReplyDelete