“আমি কবিতার জন্য শ্রম দিয়েছি। আর এতে যে আনন্দ পেয়েছি তা অন্য কিছু হলে পেতাম না।“: সুশীল হাটুই"
জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতার এক গভীর বোধের সংযোজন কবি সুশীল হাটুই। কবিতার বিষয়গত দিক থেকে শুধু নয়, কবিতার ফর্ম নিয়ে এতো সাহসী কর্মকাণ্ড সুশীলের আগে কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। তিনি রিয়েলিস্টিক আবার চূড়ান্তরকমভাবে রোমান্টিকও।
আটের দশকে যখন কবিতার প্রকরণ নিয়ে একদল কবি সোচ্চার, কবিতাকে টেনে আনলেন ডিটেকশন রুমে, সুশীল হাটুই তখন ফিরে গেলেন চণ্ডীদাস, রামপ্রসাদ, লালনের মরমী ভাষার কাছে। নাহ্, তিনি চমকে দেওয়ার মতো একটি পঙক্তিও লেখেননি, তাঁর কোনো কবিতার সেই অর্থে পোয়েটিক হ্যাংওভার নেই। তারপরও সুশীল হাটুই পাঠককে আচ্ছন্ন রাখতে পারেন ইন্দ্রিয়-ঘনিষ্ঠ উচ্চারণে।
বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর শহরের একপ্রান্তে নির্জনে লিপিবদ্ধ করে চলেছেন তাঁর কবিতা-বিশ্বাস। মল্ল সাহিত্য পত্রিকার পক্ষ থেকে বিনয়ী, নম্র, মৃদভাষী, আন্তরিক এই কবির সঙ্গে কথা বলেছেন তরুণ কবি, সম্পাদক, গবেষক ড. চন্দন বাঙ্গাল।
মল্ল সাহিত্য : সুশীলদা, আপনার আগের দশক সাতের দশক। বিভিন্ন আন্দোলনে বাংলা উত্তাল। আপনাদেরকে অনেক রক্তাক্ত পথ দুপায়ে অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। কবিতায় এলেন কীভাবে?
সুশীল হাটুই: আমি ' বিষ্ণুপুর হাই স্কুল'-এ পড়তাম। স্কুল থেকে প্রতি বছর 'কিশোর' নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করা হত। আমি একবার সেখানে একটা কবিতা দিয়েছিলাম। কবিতাটি ছাপা হয়েছিল। এটাকে আমার কবিতা লেখার প্রথম অঙ্কুর বলতে পার। তারপর আমি কবিতা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। ১৯৮০/৮১ সালে আবার লিখতে চেষ্টা করি।
মল্ল সাহিত্য : আপনার আগের দশকে শ্লোগান উঠেছিল, কবিতার গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার। এই প্রবণতা আপনার সময়ের প্রথমদিকের অজস্র কবিতায় লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু আপনি এসবের সম্পূর্ণ বিপরীতে, পোস্টমডার্ন কবিতার চর্চা করে গেছেন। পোস্টমডার্ন কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হলেন কীভাবে?
সুশীল হাটুই: আমি তখন কবিতা লিখে বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতে শুরু করলাম। কিন্তু কোনো পত্রিকাই আমার কবিতা মনোনীত করেনি। আমি কবিতা লেখা বন্ধ করে দিলাম। ১৯৯০-এ আবার লিখতে শুরু করলাম। ২/১টি স্থানীয় পত্রিকায় কবিতা ছাপা হল। আমি একদিন সাহস করে কবিতাপাক্ষিক-এ একটা কবিতা পাঠালাম। নির্বাচিত হয়নি। কিন্তু শ্রদ্ধেয় প্রভাত চৌধুরী আমাকে একটা পোস্টকার্ড পাঠালেন। আমাকে কবিতা পাঠাতে বললেন। উৎসাহ দিলেন। কবিতা পাঠালাম। পোস্টমডার্ন কবিতার নতুনত্বে মুগ্ধ হলাম। সেই থেকেই এই সামান্য লেখালেখি।
মল্ল সাহিত্য : প্রভাত চৌধুরী তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এমনকি উত্তর পর্বের কবিতা গ্রন্থে জানিয়েছেন "আমি রবীন্দ্রনাথের হয়ে কবিতা লিখি।" আপনি প্রভাত চৌধুরীকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা কী?
সুশীল হাটুই: প্রভাত চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ-কে খুব শ্রদ্ধা করতেন। আমি একবার তাঁকে প্রণাম করতে গেলে তিনি প্রণাম নিলেন না। বললেন, শুধু রবীন্দ্রনাথ-কে প্রণাম করবে। রবীন্দ্রনাথ এবং প্রভাত চৌধুরী-র কবিতার জগৎ আলাদা। প্রভাতদা পোস্টমডার্ন চিন্তাভাবনার একজন পথিকৃৎ। আমার মনে হয় প্রভাতদা-র ধারণা ছিল, রবীন্দ্রনাথ এই সময় জীবিত থাকলে, পোস্টমডার্ন কবিতা লিখতেন। তিনি (রবীন্দ্রনাথ) যেহেতু সশরীরে নেই, তাই প্রভাতদা আমি রবীন্দ্রনাথের হয়ে কবিতা লিখছি, বলতেন।
মল্ল সাহিত্য : প্রভাত চৌধুরীর কবিতা আপনাকে আলোড়িত করেছে কখনো?
সুশীল হাটুই: প্রভাতদা-র কবিতা আমার কাছে এক বিষ্ময়। আমি তাঁর কবিতা পড়ে বারবার আন্দোলিত হয়েছি। এখনো হই। প্রভাতদা-র লেখা 'সাক্ষাৎকার' আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিতার বই।
মল্ল সাহিত্য : পোস্টমডার্ন কবিতা নিজেই বিশেষ দর্শন ভাবনার ফসল। তার উপর আপনার কবিতারও নিজস্ব একটা দর্শন আছে। মানে আমরা বলতে চাইছি, অমিতাভ মৈত্র, নাসের হোসেন, গৌরাঙ্গ মিত্র, মুরারি সিঙ্গি এমনকি শান্তনু গঙ্গারিডি আপনারা সবাই একই প্ল্যাটফর্মে কবিতা লিখলেও আপনার কবিতাকে অনায়াসে আলাদা করা যায়। এই যে সকলের মাঝে থেকেও আলাদা হয়ে উঠা। এটা কী আপনার সচেতন প্রচেষ্টা সুশীলদা?
সুশীল হাটুই: আমি যখন কবিতা লিখি, একটা ঘোরের মধ্যেই লিখি। কিন্তু কবিতা লেখার আগে একটা সচেতনতা থাকে। তা হল, নতুন বিষয় নিয়ে কবিতা লেখা। আর সহজ ভাষায় কথা বলা। তাই হয়তো আমার কবিতা কিছুটা আলাদা।
মল্ল সাহিত্য : আপনার কবিতায় সময় সরাসরি কখনোই আসেনি। এসেছে সময়ের অজস্র টুকরো, ভগ্নাংশ। অথচ, রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কবিতায় প্রত্যেক কবিই সময়কে সরাসরি কবিতায় ব্যবহার করেছেন। আপনি কবিতার উপাদান হিসেবে সরাসরি সময়কে ব্যবহার না করে সময়ের টুকরোকে, ভগ্নাংশকে ব্যবহার করেন কেন?
সুশীল হাটুই: যখন একটি কবিতায় সময়কে সরাসরি ধরা হয়, তখন আমার ভয় হয়, একঘেয়েমি চলে আসতে পারে। তাই যাতে কবিতায় একঘেয়েমি না আসে তার জন্য আমি সময়ের টুকরোকে ভগ্নাংশ হিসাবে ব্যবহার করি। আমার মনে হয়, এতে কবিতা অনেকটা নতুন মাত্রা পায়।
মল্ল সাহিত্য : আপনার কবিতায় মিথিক উপাদানের প্রত্যাবর্তন আছে। বিষ্ণু দে-র উর্বশী ও আর্টেমিস, সুশীল হাটুইয়ের কফি with উর্বশী। আর্টেমিসকে বাদ দিলেন কেন? আবার দেখুন অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা আপনার কাছে গন্ধ-সাবানের ক্লিওপেট্রা। অ্যারোমেটিক সোপের ক্লিওপেট্রা নয়। এটা কী বিশ্বায়নের আগ্রাসী স্টিম রোলারকে আটকানোর চেষ্টা? নাকি নস্টালজিয়া?
সুশীল হাটুই: কবি বিষ্ণু দে 'উর্বশী ও আর্টেমিস' লিখেছেন। আমি অন্যভাবে লিখেছি, 'কফি with উর্বশী'। আর্টেমিস-য়ের কথা একজন মহৎ কবি বলেছেন। আমি নিজেরমতো করে উর্বশীর সঙ্গে কফি পানের কথা বললাম। আর যদি 'গন্ধ-সাবানের ক্লিওপেট্রা'-র কথা বলো, তাহলে বলব, এটা নস্টালজিয়া ছাড়া কিছু নয়।
মল্ল সাহিত্য : আপনার কবিতা সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রত্যাশা মেশানো। অথচ আপনার কবিতায় অতি সাম্প্রতিক বিষয় উপাদান হিসেবে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। এধরনের বৈপরীত্যের সম্মুখীন হলে, পাঠককে আপনি কী বলবেন?
সুশীল হাটুই: একই মানুষের একাধিক সত্তা থাকে। কবিরা এর থেকে মুক্ত নয়। আমার কবিতায় তুমি
দেখেছ, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রত্যাশা। আবার কখনো দেখছ, সাম্প্রতিক বিষয়ের উপস্থিতি। দুটোই সত্যি। এটা নতুন কিছু নয়। এটাকে বৈপরীত্য না বলে অন্য কিছু বলাই ভালো। পোস্টমডার্নিজম বৈপরীত্যে বিশ্বাস করে না। আমি পাঠকদের বলব প্রতিটি কবিতা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে।
মল্ল সাহিত্য : সুশীলদা, আপনি যখন লিখতে এলেন তখন বাংলা কবিতা অনেক ধারায় বিভক্ত। মেইন স্ট্রিমের সমান্তরালে পোস্টমডার্ন কবিতা, নতুন কবিতা, ভাষা বদলের কবিতা ইত্যাদি। এতগুলো অপশন থেকে আপনি পোস্টমডার্ন কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হলেন কিভাবে?
সুশীল হাটুই: আধুনিক কবিতা আমার কাছে ম্যাড়মেড়ে লাগছিল। পোস্টমডার্ন কবিতায় আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম, তার সীমাকে অতিক্রম করার সাহস দেখে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন কবির কবিতায় পোস্টমডার্নিজমের বহুরৈখিকতা বিনির্মাণ যুক্তিহীনতা লজিক্যাল ক্লেফটের প্রয়োগ দেখেও আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম। তারপর থেকেই আমি পোস্টমডার্ন কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরি করি।
মল্ল সাহিত্য : কাব্যগ্রন্থের নামকরণের ক্ষেত্রে আপনি অনেক ক্ষেত্রেই অতীতকালকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে টেনে এনেছেন। বেশ কিছু ক্ষেত্রে এদের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক রয়েছে। যেমন ধরুন ‘হিটলারের খড়ম’। হিটলারের মতো শাসকের পায়ে খড়ম কি মানায়?
সুশীল হাটুই: তুমি প্রশ্ন তুলেছ, হিটলারের মতো শাসকের পায়ে খড়ম কি মানায়? এর উত্তরে আমি বলব, পোস্টমডার্ন কবিতায় যুক্তিকাঠামোকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। সেই হিসাবে কবিতা বা কবিতাবইয়ের নাম যুক্তিহীন হতেই পারে।
মল্ল সাহিত্য : বেশ কিছু সামাজিক উপাদান আপনার কবিতায় শ্লেষ হিসেবে উঠে এসেছে। সরাসরি এই প্রসঙ্গ আসেনি কেন?
সুশীল হাটুই: আমার মনে হয়, শ্লেষ তির্যককথা বিদ্রুপ এ-সব দিয়েও প্রতিবাদ করা যায়। তাই আমি কবিতায় বারবার শ্লেষ প্রয়োগ করি। আমি সরাসরি এই প্রসঙ্গে আসিনি কেন সেটা মুখ্য নয়। আমার শ্লেষগুলো লক্ষ্যবস্তুকে কতটা অস্বস্তিতে ফেলল সেটাই বড়ো কথা।
মল্ল সাহিত্য : বিশেষ কোনো চেতনা বা ইজম কী কবিতার কোনো ক্ষতি করে?
সুশীল হাটুই: আমি বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে কবিতাকে যুক্ত করা ঠিক নয়। আমার মনে হয়, কবিতায় কোনো নির্দিষ্ট চেতন বা ইজম এলে কবিতাটি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।
মল্ল সাহিত্য : আপনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন সুশীলদা। আটের দশকের বেশিরভাগ মানুষ যখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তখন আপনি হঠাৎ ব্যাংকিং সেক্টরে কাজ নিলেন। কেন নিজের মেধা ও শ্রমকে আপনি সময় দিলেন না?
সুশীল হাটুই: অনেকেই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অথবা প্রশাসনিক কর্মকর্তা হতে চেয়েছে। আমি চাইনি। বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। আমি কীভাবে একটা কাজ পাব, সেই চিন্তায় রাতের পর রাত ঘুমোইনি। আমি নিজের মেধা ও শ্রমকে সময় দিলাম না, একথা ঠিক নয়। আমি কবিতার জন্য শ্রম দিয়েছি। আর এতে যে আনন্দ পেয়েছি তা অন্য কিছু হলে পেতাম না।
মল্ল সাহিত্য : এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। কখনো কারো লিপস্টিক আপনাকে খেপিয়েছে সুশীলদা?
সুশীল হাটুই: কারো লিপস্টিক আমাকে খেপিয়েছে বললে মিথ্যা বলা হবে। তবে আমার ঠোঁটকে বারবার খেপিয়েছে।
মল্ল সাহিত্য : এই মুহূর্তে বাংলা কবিতার অবস্থা আপনার কাছে কেমন মনে হয়?
সু: হা: বাংলা কবিতা বইয়ের বিক্রি খুব কম বলেই মনে হয়। আর যদি কবিতার কথা বলো, তাহলে বলব, সেই একই রকমের গতানুগতিক লেখা। তবু তারইমধ্যে অনেকেই প্রথাবিরোধী কবিতা লেখার জন্য আগ্রহী হচ্ছে। এটা খুব ভালো লক্ষণ।
মল্ল সাহিত্য : নতুন যাঁরা লিখতে আসছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?
সুশীল হাটুই: নতুন যাঁরা লিখতে আসছেন তাঁরা আমার কথা শুনবেন কেন? তবে সত্যিই যদি কেউ
শুনতে আগ্রহী হয়, তাঁকে বলব, প্রভাত চৌধুরীর-র কবিতা পড়ুন, মুরারি সিংহ-র কবিতা পড়ুন, আফজল আলি-র কবিতা পড়ুন। আমি এঁদের কবিতা পড়েই নিজেকে আপডেট করার চেষ্টা করি।
মল্ল সাহিত্য : মল্ল সাহিত্য পত্রিকার পক্ষ থেকে অনেক শ্রদ্ধা আপনাকে।
সুশীল হাটুই: ধন্যবাদ চন্দন। ধন্যবাদ মল্ল সাহিত্য পত্রিকা।
সাক্ষাৎকারটি পড়লাম। খুব ভালো লাগলো। সুশীল বাবুকে আমি চিনি ওনার কবিতা আমি দারুণ উৎসাহের সাথেই পড়ি । যারা সুশীল হাটুই এর একটি কবিতাও কখনো পড়েছেন। আমি হলফ করে বলতে পারি পরবর্তী সময়ে কোনো পত্রিকায় যদি ১০০ কবিতা থাকে সর্ব প্রথমে সুশীল হাটুই এর কবিতাটি খুঁজে নিয়ে পড়বেন
ReplyDelete। .....নিমাই কোলে / বিষ্ণুপুর