লেনিয়াদ্রি গুহা || রিতা মিত্র
এবারে আমার যাত্রা ছিল মহারাষ্ট্রের পশ্চিম ঘাট। যার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্য মাত্রার ।বিশেষ করে বর্ষার মরশুমে।
আরব সাগরের হাওয়া এসে এই পাহাড়ের গায়ে আটকে যায় ফলে বৃষ্টির পরিমাণ খুব এবং পাহাড়ি অঞ্চল বলে পাহাড়ে গা বেয়ে হাজার জলধারা নেমে আসে। এই অঞ্চলকে থাউজেন্ড সিস্টার ফল বললে কম বলা হয়।
আমরা যাব লেনিয়াদ্রি গুহা। এই জায়গা গণেশ গুহা বা গণেশ পাহাড় বলে খ্যাত।
কেননা পাহাড়ের এক গুহায় গণেশ দেবের পুজো হয়ে থাকে।
লেনিয়াদ্রি গুহা মহারাষ্ট্রের পুনে জেলার জুন্নার শহরের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এখানে পাহাড় কেটে প্রায় তিরিশটি গুহা নির্মাণ করা হয়। ইতিহাসবিদ দের কথায় এর নির্মাণ কাল প্রথম শতাব্দী থেকে তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে।
মুলত এই গুহাগুলি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কিন্তু সাত নম্বর গুহাটি হিন্দুদের দখলে চলে যায় এবং এখানে গণশের অষ্টবিনায়ক মূর্তি পূজো আরম্ভ হয়। গণেশ পুরাণ এর মতে দেবি পার্বতী বারো বছর তপস্যা করে গণেশকে পুত্র রুপে পান।
এখানে প্রবেশ মুল্য পঁচিশ টাকা। গাড়ি পার্কিং আলাদা। গুহায় উঠছে ৩৩৮ টি খাড়াই সিঁড়ি উঠতে হবে। বৃষ্টির জলে বেশ পিচ্ছিল থাকে। বয়স্কদের জন্য ডুলির ব্যবস্থা আছে হাজার টাকা মাথা পিছু। আমিও ডুলিতে উঠে বসলাম। কেননা আগের দিন প্রচুর হাঁটাহাঁটি করে সাড়ে চারশ সিঁড়ি বেয়ে ঘুরে কোমরে হাঁটুতে খুব ব্যথা হয়েছে।
চারজন মিলে ডুলি বয়ে নিয়ে চলল জোর কদমে। আমি ভয়ে মরেই যাই এত জোরে ছুটছে সিঁড়িতে যদি ওদের পা পিছলে যায় তবে আমার স্বর্গের টিকিট পাকা।
প্রায় দুশো সিঁড়ি উঠে একবারে জন্য বিশ্রাম তাও দু মিনিট এর জন্য আবার সেই দৌড়। একেবারে অষ্টবিনায়ক মন্দির সামনে নামাল।। বৃষ্টি ছিলনা বলে এতটা পথ শুকনো এসেছি কিন্তু আর উপায় নেই। মন্দিরে প্রবেশ করতে হলে গুহায় যেতে হবে আর পাহাড়ের গা বেয়ে সহস্র ধারার মতো জল পড়েই যাচ্ছে ক্রমশ।
সিঁড়ি ওঠা শেষ হয়েও হল না। আরো দশ বারোটা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। আর সিঁড়ির ধাপ এত উচুঁ যে হাঁটু কপালে ঠেকে যাবার জোগাড়। কোনো মতে বসে বসে একধাপ একধাপ করে উঠে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। বিশাল এক নাথ মন্দিরের মতো জায়গা। প্রায় দেড়শ লোক এটে যাবে এক সাথে। পাথরের মেঝেতে অনেকে বসে আছেন হাত জোড় করে। একদিকে পুরুত মশাই পূজো দিয়ে যাচ্ছেন। প্রবেশ পথের পিলারে হাতি সিংহের মূর্তি পাথর কেটে করা আছে। ভেতরে ছবি তোলা বারণ। তাই বায়রনের ছবি তুললাম।
আবার নেমে একটি কক্ষে প্রবেশ করলাম। এখানে কোনো মূর্তি নেই। একটি মঙ্গল কলস পাথর কেটে তৈরি করা যা মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিশাল। অনেক গুলি পাথরের থাম রয়েছে কক্ষ জুড়ে।
বাইরে বেরিয়ে পাশের গুহাগুলি দেখতে যেতেই সবাই বলল ওগুলো তালা বন্ধ
। তাও এগিয়ে গেলাম। লক্ষ করলাম সেগুলো বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধ্যান কক্ষ। বাকিগুলো সত্যি তালা বন্ধ। এত উপরেও প্রাচীন কালে জল ধরে রাখার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বৃষ্টির জল পাহাড় বেয়ে এই পাথরের কুণ্ড গুলোতে জমা হত। যা সারা বছর ধরে ব্যবহার করা হত।
এখানে দাঁড়িয়ে জুন্নার শহরের অনেকটা দেখা যায়। প্রচুর গাছপালা চারিদিকে। বর্ষার ছোঁয়া পেয়ে নব যুবতীর মতো খিলখিল হাসছে। কত পাখির গান শুনলাম। পথের ধারে পাহাড়ি সিঁড়ির উপরে কোথাও কোথাও বাঁদর বাবাজীরা সদলবলে বসে আছেন। অনেকে কলা আপেল খেতে দিচ্ছে। কিন্তু বাঁদর বাবাজীরা জলের বোতল দেখলেই হামলে পড়ে কেড়ে নিচ্ছে। আমাদের দলের সর্বকনিষ্ঠ যাত্রী ঈশিতার জলের বোতল তারা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিয়েছে।
ডুলি করে আবার নেমে এলাম। আমরা তিনজন ডুলি করে গিয়েছিলাম।যখন নামছি তখন দলের বাকিরা উঠছে। তাদের অর্ধেক পথ বাকি।
নিচে নেমে দোকান থেকে প্রসাদ কিনলাম। লাড্ডু প্রসাদ দুটো তিরিশ টাকা।
এক কাপ চা নিয়ে বাকিদের নেমে আসার অপেক্ষা সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
No comments:
Post a Comment