এই বনপথে || তপজা মিত্র
আমি যে রাস্তায় হাঁটতে চেয়েছি এখনও সেই রাস্তায় হাঁটতে পারিনি। প্রলয়কালে বুদ্ধিনাশ হল কি আমার? এমনই ভাবছেন মনু, মানবজাতির পিতা। বৈবস্বত মনুর চিন্তাক্লিষ্ট মুখে বলিরেখা স্পষ্ট। দত্তাত্রেয় তুমি জানো কোন সে পথ যে পথে আমি, আমরা হাঁটতে চেয়েছি! কিন্ত তুমি বলবে না। তোমার কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। বিক্রি হয়ে গিয়েছে। অথচ একদিন তুমি ছিলে বাঙ্ময়, ছিলে নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য থেকে উঠে আসা এক ভৈরব। তুমি পাললিক, আগ্নেয় শিলার মানদণ্ডে জীবনকে না মেপে কখনও এঁটেল, কখনও দোঁআশ মাটিতে জীবনের বীজ বপন করেছ। ফসলও ফলেছে, উত্তুঙ্গ সেই ফসলের শীর্ষে যখন সূর্যের আলো পড়ে তখন চরাচরে তা প্রতিফলিত হয়। এই প্রতিফলন মাটিকে স্পর্শ করেছে। দত্তাত্রেয় যা করেছে জনমেজয় কি তাই করেছে? সর্পযজ্ঞ করা কী উচিত? আস্তিকের সংলাপে রক্ষা পাক চির বনপথের আজানুলম্বিত সাপ প্রজন্ম।
রক্ষাই পেতে হবে। প্রভু রক্ষা করতে হবে। নদী, গাছ, ছোট ছোট গুল্ম, পরাণ-পীরিতি, গিরিখাদ, খনি গহ্বরের উচ্চারিত অন্ধকার....সব সব সব বাঁচাতে হবে। জানি যে পথ দিয়ে মনু হাঁটতে চান সেই পথ তিনি খুঁজছেন, কিন্ত পাচ্ছেন না। সময় খুব জটিল। কলসী কাঁখে জল তুলতে কেউ আর এদিকে আসে না। শিরশির করে হাওয়া বয়, তিরতির করে জল বয়ে চলে , কেউ আর এ ঘাটের রানায় এসে বসে না। উত্তরকালের ভাবী প্রজন্মকে আশীর্বাদ করার জন্য পূর্ব কালের পারিজাতরা আর এদিকে আসেন না।
মনু শ্রান্ত। বটগাছের ছায়ায় এসে বসলেন। অন্ধকার চারপাশ। মনু চোখ বন্ধ করলেন। এখন আর কোনও বনপথে হাঁটা যাবে না। এই তমসায়, ঘনঘোর মননহীন বিটপীলতায় সোনালি, রূপালি রেখার ছোঁয়া পার হয়ে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব।
তাহলে উপায়?
মনু গিয়ে বসলেন রাজহংসের পাশে। বেলা পড়ে আসছে, সূর্যের আলোর প্রকাশ ক্রমশ কম। গঙ্গার নিস্তব্ধ জলে কোনও তরঙ্গ নেই। মনুর মনে হল জীবন আর গতিশীল নয় যেন। এই বেলা চলে যেতে হবে এখান থেকে।
দূরে ধুলো উড়িয়ে ছুটে আসছে এক ঘোড়সওয়ার।
কে তুমি?
আমি চিঠিবাহক।
তুমি রানার!
যা বলবে। তুমি কে?
মনু। মানবজাতির পিতা।
কী করছ এখানে?
গানের সুর খুঁজছি।
পেলে?
না।
তুমি কার চিঠি বিলি করবে?
সন্ন্যাসীর।
কে তিনি?
চেন না তাঁকে? তিনি ব্যাসদেব।
এই চিঠি দেবর্ষি নারদের। তাঁকে পৌঁছে দিতে হবে।
কোথায় থাকেন তিনি?
সেই রাস্তাই তো খুঁজছি মহাত্মন!
তুমিও রাস্তা খুঁজছ?
আমরা দুজনেই নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছনর রাস্তা খুঁজছি, কিন্ত পাচ্ছি না। বনপথের নিবিড়, ধীর রাস্তাই আমাদের অভীপ্সা।
সেই রাস্তা কোথায়?
একটি রাস্তা আছে জানি তা গিয়েছে সত্যের দিকে, ন্যায়ের দিকে, আচমন ও নৈবেদ্যের দিকে। সেই রাস্তাই প্রণামের জ্যোতিতে পরিপূর্ণ।
চলো এগিয়ে যাই...। যদি খুঁজে পাই বনপথ!
No comments:
Post a Comment