Tuesday, 8 October 2024

শারদীয় সংখ্যা ১৪৩১ || প্রচ্ছদ

 প্রচ্ছদ




শারদীয় সংখ্যা ১৪৩১ || সম্পূর্ণ সূচি

 সম্পূর্ণ সূচি

মুখোমুখি সুশীল হাটুই ও ড. চন্দন বাঙ্গাল
তৃষ্ণা বসাক
বিভাবসু
পল্লববরন পাল
ঋতবৃতা মুখোপাধ্যায় 











বিশ্বজিৎ রায়
রিতা মিত্র
তপজা মিত্র
শাশ্বত গঙ্গোপাধ্যায় 
Rina Kansabanik
জয়াশিষ ঘোষ


নীলাব্জ চক্রবর্তী 
সৌরভ বর্ধন
প্রদীপ আচার্য
দেবব্রত রায়
নির্মল রায়
কার্তিক ঢক্

তামিমৌ ত্রমি
অভিজিৎ দাস কর্মকার 







শারদীয় সংখ্যা ১৪৩১ || সম্পাদকীয় নয় কিন্তু

 



সম্পাদকীয় নয় কিন্তু || অভিজিৎ দাস কর্মকার 

আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে ওঠে আলোক মঞ্জির। আলো কোথায়! চারিদিক তো হা হা করছে যেদিকে তাকাই। অতিবৃষ্টিতে ধসে পড়া বাড়ি-ঘর, ভেসে আসছে গবাদি পশু-আাদির ফুলে ওঠা দেহ। কতো শুক্রাণু যোনি ছিঁড়ে ফেলেছে।  স্তনাগ্র কামড়ানো কিসকিসে দাঁতের কিড়মিড় শব্দের ছোঁয়াচ লেগেছে রাস্তার কোনায় কোনায়। গেয়ে চলেছে রাত, নতুন ভোরের আশায় জেগে রয়েছে সরস মানুষের কত-শত অবয়ব। আমরাও দখল করব নবপত্রিকা, শ্বাসমূল আর সমগ্র রাতের ছটা। শান্ত হোক মন। শান্ত হোক আমার মাটি। শান্ত হোক ঘনঘটা। বিচার্য বিষয়গুলো আরো তীব্রতর হোক প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে। সকলে সুস্থ থাকুক এই অঙ্গীকারবদ্ধ হই আজকের সকালে।


শারদীয় সংখ্যা ১৪৩১|| মুখোমুখি সুশীল হাটুই ও ডঃ চন্দন বাঙ্গাল

 


“আমি কবিতার জন্য শ্রম দিয়েছি। আর এতে যে আনন্দ পেয়েছি তা অন্য কিছু হলে পেতাম না।“: সুশীল হাটুই"



জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতার এক গভীর বোধের সংযোজন কবি সুশীল হাটুই। কবিতার বিষয়গত দিক থেকে শুধু নয়, কবিতার ফর্ম নিয়ে এতো সাহসী কর্মকাণ্ড সুশীলের আগে কেউ করেছেন বলে মনে হয় না। তিনি রিয়েলিস্টিক আবার চূড়ান্তরকমভাবে রোমান্টিকও।

আটের দশকে যখন কবিতার প্রকরণ নিয়ে একদল কবি সোচ্চার, কবিতাকে টেনে আনলেন ডিটেকশন রুমে, সুশীল হাটুই তখন ফিরে গেলেন চণ্ডীদাস, রামপ্রসাদ, লালনের মরমী ভাষার কাছে। নাহ্, তিনি চমকে দেওয়ার মতো একটি পঙক্তিও লেখেননি, তাঁর কোনো কবিতার সেই অর্থে পোয়েটিক হ্যাংওভার নেই। তারপরও সুশীল হাটুই পাঠককে আচ্ছন্ন রাখতে পারেন ইন্দ্রিয়-ঘনিষ্ঠ উচ্চারণে।

বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর শহরের একপ্রান্তে নির্জনে লিপিবদ্ধ করে চলেছেন তাঁর কবিতা-বিশ্বাস। মল্ল সাহিত্য  পত্রিকার পক্ষ থেকে বিনয়ী, নম্র, মৃদভাষী, আন্তরিক এই কবির সঙ্গে কথা বলেছেন তরুণ কবি, সম্পাদক, গবেষক ড. চন্দন বাঙ্গাল।

মল্ল সাহিত্য : সুশীলদা, আপনার আগের দশক সাতের দশক। বিভিন্ন আন্দোলনে বাংলা উত্তাল। আপনাদেরকে অনেক রক্তাক্ত পথ দুপায়ে অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। কবিতায় এলেন কীভাবে?

সুশীল হাটুই: আমি ' বিষ্ণুপুর হাই স্কুল'-এ পড়তাম। স্কুল থেকে প্রতি বছর 'কিশোর' নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করা হত। আমি একবার সেখানে একটা কবিতা দিয়েছিলাম। কবিতাটি ছাপা হয়েছিল। এটাকে আমার কবিতা লেখার প্রথম অঙ্কুর বলতে পার। তারপর আমি কবিতা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। ১৯৮০/৮১ সালে আবার লিখতে চেষ্টা করি।

 

মল্ল সাহিত্য : আপনার আগের দশকে শ্লোগান উঠেছিল, কবিতার গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার। এই প্রবণতা আপনার সময়ের প্রথমদিকের অজস্র কবিতায় লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু আপনি এসবের সম্পূর্ণ বিপরীতে, পোস্টমডার্ন কবিতার চর্চা করে গেছেন। পোস্টমডার্ন কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হলেন কীভাবে?

সুশীল হাটুই: আমি তখন কবিতা লিখে বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতে শুরু করলাম। কিন্তু কোনো পত্রিকাই আমার কবিতা মনোনীত করেনি। আমি কবিতা লেখা বন্ধ করে দিলাম। ১৯৯০-এ আবার লিখতে শুরু করলাম। ২/১টি স্থানীয় পত্রিকায় কবিতা ছাপা হল। আমি একদিন সাহস করে কবিতাপাক্ষিক-এ একটা কবিতা পাঠালাম। নির্বাচিত হয়নি। কিন্তু শ্রদ্ধেয় প্রভাত চৌধুরী আমাকে একটা পোস্টকার্ড পাঠালেন। আমাকে কবিতা পাঠাতে বললেন। উৎসাহ দিলেন। কবিতা পাঠালাম। পোস্টমডার্ন কবিতার নতুনত্বে মুগ্ধ হলাম। সেই থেকেই এই সামান্য লেখালেখি।

 

মল্ল সাহিত্য : প্রভাত চৌধুরী তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এমনকি উত্তর পর্বের কবিতা গ্রন্থে জানিয়েছেন "আমি রবীন্দ্রনাথের হয়ে কবিতা লিখি।" আপনি প্রভাত চৌধুরীকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এ বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা কী?

সুশীল হাটুই: প্রভাত চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ-কে খুব শ্রদ্ধা করতেন। আমি একবার তাঁকে প্রণাম করতে গেলে তিনি প্রণাম নিলেন না। বললেন, শুধু রবীন্দ্রনাথ-কে প্রণাম করবে। রবীন্দ্রনাথ এবং প্রভাত চৌধুরী-র কবিতার জগৎ আলাদা। প্রভাতদা পোস্টমডার্ন চিন্তাভাবনার একজন পথিকৃৎ। আমার মনে হয় প্রভাতদা-র ধারণা ছিল, রবীন্দ্রনাথ এই সময় জীবিত থাকলে, পোস্টমডার্ন কবিতা লিখতেন। তিনি (রবীন্দ্রনাথ) যেহেতু সশরীরে নেই, তাই প্রভাতদা আমি রবীন্দ্রনাথের হয়ে কবিতা লিখছি, বলতেন।

 

মল্ল সাহিত্য : প্রভাত চৌধুরীর কবিতা আপনাকে আলোড়িত করেছে কখনো?

সুশীল হাটুই: প্রভাতদা-র কবিতা আমার কাছে এক বিষ্ময়। আমি তাঁর কবিতা পড়ে বারবার আন্দোলিত হয়েছি। এখনো হই। প্রভাতদা-র লেখা 'সাক্ষাৎকার' আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিতার বই।

 

মল্ল সাহিত্য : পোস্টমডার্ন কবিতা নিজেই বিশেষ দর্শন ভাবনার ফসল। তার উপর আপনার কবিতারও নিজস্ব একটা দর্শন আছে। মানে আমরা বলতে চাইছি, অমিতাভ মৈত্র, নাসের হোসেন, গৌরাঙ্গ মিত্র, মুরারি সিঙ্গি এমনকি শান্তনু গঙ্গারিডি আপনারা সবাই একই প্ল্যাটফর্মে কবিতা লিখলেও আপনার কবিতাকে অনায়াসে আলাদা করা যায়। এই যে সকলের মাঝে থেকেও আলাদা হয়ে উঠা। এটা কী আপনার সচেতন প্রচেষ্টা সুশীলদা?

সুশীল হাটুই: আমি যখন কবিতা লিখি, একটা ঘোরের মধ্যেই লিখি। কিন্তু কবিতা লেখার আগে একটা সচেতনতা থাকে। তা হল, নতুন বিষয় নিয়ে কবিতা লেখা। আর সহজ ভাষায় কথা বলা। তাই হয়তো আমার কবিতা কিছুটা আলাদা।

 

মল্ল সাহিত্য : আপনার কবিতায় সময় সরাসরি কখনোই আসেনি। এসেছে সময়ের অজস্র টুকরো, ভগ্নাংশ। অথচ, রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কবিতায় প্রত্যেক কবিই সময়কে সরাসরি কবিতায় ব্যবহার করেছেন। আপনি কবিতার উপাদান হিসেবে সরাসরি সময়কে ব্যবহার না করে সময়ের টুকরোকে, ভগ্নাংশকে ব্যবহার করেন কেন?

সুশীল হাটুই: যখন একটি কবিতায় সময়কে সরাসরি ধরা হয়, তখন আমার ভয় হয়, একঘেয়েমি চলে আসতে পারে। তাই যাতে কবিতায় একঘেয়েমি না আসে তার জন্য আমি সময়ের টুকরোকে ভগ্নাংশ হিসাবে ব্যবহার করি। আমার মনে হয়, এতে কবিতা অনেকটা নতুন মাত্রা পায়।

 

মল্ল সাহিত্য : আপনার কবিতায় মিথিক উপাদানের প্রত্যাবর্তন আছে। বিষ্ণু দে-র উর্বশী ও আর্টেমিস, সুশীল হাটুইয়ের কফি with উর্বশী। আর্টেমিসকে বাদ দিলেন কেন? আবার দেখুন অ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা আপনার কাছে গন্ধ-সাবানের ক্লিওপেট্রা। অ্যারোমেটিক সোপের ক্লিওপেট্রা নয়। এটা কী বিশ্বায়নের আগ্রাসী স্টিম রোলারকে আটকানোর চেষ্টা? নাকি নস্টালজিয়া?

সুশীল হাটুই: কবি বিষ্ণু দে 'উর্বশী ও আর্টেমিস' লিখেছেন। আমি অন্যভাবে লিখেছি, 'কফি with উর্বশী'। আর্টেমিস-য়ের কথা একজন মহৎ কবি বলেছেন। আমি নিজেরমতো করে উর্বশীর সঙ্গে কফি পানের কথা বললাম। আর যদি 'গন্ধ-সাবানের ক্লিওপেট্রা'-র কথা বলো, তাহলে বলব, এটা নস্টালজিয়া ছাড়া কিছু  নয়।

 

মল্ল সাহিত্য : আপনার কবিতা সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রত্যাশা মেশানো। অথচ আপনার কবিতায় অতি সাম্প্রতিক বিষয় উপাদান হিসেবে বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। এধরনের বৈপরীত্যের সম্মুখীন হলে, পাঠককে আপনি কী বলবেন?

সুশীল হাটুই: একই মানুষের একাধিক সত্তা থাকে। কবিরা এর থেকে মুক্ত নয়। আমার কবিতায় তুমি

দেখেছ, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রত্যাশা। আবার কখনো দেখছ, সাম্প্রতিক বিষয়ের উপস্থিতি। দুটোই সত্যি। এটা নতুন কিছু নয়। এটাকে বৈপরীত্য না বলে অন্য কিছু বলাই ভালো। পোস্টমডার্নিজম বৈপরীত্যে বিশ্বাস করে না। আমি পাঠকদের বলব প্রতিটি কবিতা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে।

 

মল্ল সাহিত্য : সুশীলদা, আপনি যখন লিখতে এলেন তখন বাংলা কবিতা অনেক ধারায় বিভক্ত। মেইন স্ট্রিমের সমান্তরালে পোস্টমডার্ন কবিতা, নতুন কবিতা, ভাষা বদলের কবিতা ইত্যাদি। এতগুলো অপশন থেকে আপনি পোস্টমডার্ন কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হলেন কিভাবে?

সুশীল হাটুই: আধুনিক কবিতা আমার কাছে ম্যাড়মেড়ে লাগছিল। পোস্টমডার্ন কবিতায় আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম, তার সীমাকে অতিক্রম করার সাহস দেখে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন কবির কবিতায় পোস্টমডার্নিজমের বহুরৈখিকতা বিনির্মাণ যুক্তিহীনতা লজিক্যাল ক্লেফটের প্রয়োগ দেখেও আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম। তারপর থেকেই আমি পোস্টমডার্ন কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরি করি।

 

মল্ল সাহিত্য : কাব্যগ্রন্থের নামকরণের ক্ষেত্রে আপনি অনেক ক্ষেত্রেই অতীতকালকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে টেনে এনেছেন। বেশ কিছু ক্ষেত্রে এদের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক রয়েছে। যেমন ধরুন ‘হিটলারের খড়ম’। হিটলারের মতো শাসকের পায়ে খড়ম কি মানায়?

সুশীল হাটুই: তুমি প্রশ্ন তুলেছ, হিটলারের মতো শাসকের পায়ে খড়ম কি মানায়? এর উত্তরে আমি বলব, পোস্টমডার্ন কবিতায় যুক্তিকাঠামোকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। সেই হিসাবে কবিতা বা কবিতাবইয়ের নাম যুক্তিহীন হতেই পারে।

 

মল্ল সাহিত্য : বেশ কিছু সামাজিক উপাদান আপনার কবিতায় শ্লেষ হিসেবে উঠে এসেছে। সরাসরি এই প্রসঙ্গ আসেনি কেন?

সুশীল হাটুই: আমার মনে হয়, শ্লেষ তির্যককথা বিদ্রুপ এ-সব দিয়েও প্রতিবাদ করা যায়। তাই আমি কবিতায় বারবার শ্লেষ প্রয়োগ করি। আমি সরাসরি এই প্রসঙ্গে আসিনি কেন সেটা মুখ্য নয়। আমার শ্লেষগুলো লক্ষ্যবস্তুকে কতটা অস্বস্তিতে ফেলল সেটাই বড়ো কথা।

 

মল্ল সাহিত্য : বিশেষ কোনো চেতনা বা ইজম কী কবিতার কোনো ক্ষতি করে?

সুশীল হাটুই: আমি বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে কবিতাকে যুক্ত করা ঠিক নয়। আমার মনে হয়, কবিতায় কোনো নির্দিষ্ট চেতন বা ইজম এলে কবিতাটি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে।

 

মল্ল সাহিত্য : আপনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন সুশীলদা। আটের দশকের বেশিরভাগ মানুষ যখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তখন আপনি হঠাৎ ব্যাংকিং সেক্টরে কাজ নিলেন। কেন নিজের মেধা ও শ্রমকে আপনি সময় দিলেন না?

সুশীল হাটুই: অনেকেই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অথবা প্রশাসনিক কর্মকর্তা হতে চেয়েছে। আমি চাইনি। বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। আমি কীভাবে একটা কাজ পাব, সেই চিন্তায় রাতের পর রাত ঘুমোইনি। আমি নিজের মেধা ও শ্রমকে সময় দিলাম না, একথা ঠিক নয়। আমি কবিতার জন্য শ্রম দিয়েছি। আর এতে যে আনন্দ পেয়েছি তা অন্য কিছু হলে পেতাম না।

 

মল্ল সাহিত্য : এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। কখনো কারো লিপস্টিক আপনাকে খেপিয়েছে সুশীলদা?

সুশীল হাটুই: কারো লিপস্টিক আমাকে খেপিয়েছে বললে মিথ্যা বলা হবে। তবে আমার ঠোঁটকে বারবার খেপিয়েছে।

 

মল্ল সাহিত্য : এই মুহূর্তে বাংলা কবিতার অবস্থা আপনার কাছে কেমন মনে হয়?

সু: হা: বাংলা কবিতা বইয়ের বিক্রি খুব কম বলেই মনে হয়। আর যদি কবিতার কথা বলো, তাহলে বলব, সেই একই রকমের গতানুগতিক লেখা। তবু তারইমধ্যে অনেকেই প্রথাবিরোধী কবিতা লেখার জন্য আগ্রহী হচ্ছে। এটা খুব ভালো লক্ষণ।

 

মল্ল সাহিত্য : নতুন যাঁরা লিখতে আসছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?

সুশীল হাটুই: নতুন যাঁরা লিখতে আসছেন তাঁরা আমার কথা শুনবেন কেন? তবে সত্যিই যদি কেউ

শুনতে আগ্রহী হয়, তাঁকে বলব, প্রভাত চৌধুরীর-র কবিতা পড়ুন, মুরারি সিংহ-র কবিতা পড়ুন, আফজল আলি-র কবিতা পড়ুন। আমি এঁদের কবিতা পড়েই নিজেকে আপডেট করার চেষ্টা করি।

 

মল্ল সাহিত্য মল্ল সাহিত্য  পত্রিকার পক্ষ থেকে অনেক শ্রদ্ধা আপনাকে।

সুশীল হাটুই: ধন্যবাদ চন্দন। ধন্যবাদ মল্ল সাহিত্য  পত্রিকা।

শারদীয় সংখ্যা ১৪৩১ || তৃষ্ণা বসাক

 


শ্যামচন্দ্র নাহি রে || তৃষ্ণা বসাক
 
‘শুনল শুনল বালিকা
রাখো কুসুম মালিকা
কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরনু সখি শ্যামচন্দ্র নাহি রে…’
 
 
আমাদের সব আছে,
রাতের দখল নেওয়া আছে
অকাদেমি চত্বরে জমায়েত,
জমায়েত ছড়িয়ে পড়ছে কাঞ্চনজংঘা থেকে সুন্দরবন,
মিছিলে আওয়াজ আছে, শ্লোগানের অন্তাক্ষরী খেলা আছে,
 শেষে ছড়িয়ে পড়া আছে,
ছড়িয়ে পড়তে পড়তে ফেরা আছে,
কিন্তু আমাদের শ্যামচন্দ্র নাহি রে,
আমাদের  শ্যামচন্দ্র কোথাও নাহি রে!
 
 
 
আমাদের সঞ্জয় আছে, সন্দীপ আছে,
আছে ভ্রূণ ফেলার ইঁদারা,
সেই ইঁদারার মধ্যে উঁকি মারা চাঁদ,
শুধু শ্যামচন্দ্র নাহি রে, কোথাও নাহি রে!
 
আমাদের ফ্রিজে লাশ থাকে,
আর ফেলে দেওয়া হয় জীবনদায়ী ওষুধ,
আমাদের  স্বাধীনতা দিনে ভেঙে দেওয়া হয় সব আরোগ্য নিকেতন,
আমাদের শাঁখ বাজাবার লোক আছে,
কিন্তু বাঁশি? বাঁশি কে বাজাবে?
তমালের ডাল থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে রাধিকাকে,
কারণ সে বলেছিল সরপঞ্চের দুধে মাদক মেশানো আছে,
আমাদের মাদক আছে, মাধব নেই,
কোথাও, শ্যামচন্দ্র কোথাও  নাহি রে!
 
 
আমাদের পুলিশ শেষ দৃশ্যে আসে,
কিংবা আসেই না,
ওরা চলে গেছে,
যা কিছু ভাঙ্গবার ভেঙ্গে টেঙ্গে চলে গেছে জানার পর
নিশ্চিন্ত হয়ে আস্তে সুস্থে আসে ,
প্যান্টের জিপার লাগাতে লাগাতে রমণতৃপ্ত পুলিশ,
আর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে  জেগে থাকা গোলাপি ব্রাটিকে
পেলে এদিক ওদিক দেখে পকেটে পুরে নেয়,
তারপর সেঁদিয়ে যায় নার্সিং কোয়ার্টারের ভেতরে,
ওদেরও ন্যায় চাই যেহেতু!
 
আমাদের পুলিশ কালীপুজোর রাতের
শেষ রোগাসোগা বাড়ির  টুনিবাল্বের মতো,
খুব ক্বচিৎ কখনো জ্বলে ওঠে, বেশিরভাগই নিভে থাকে,
 আর সেই অবসরে  ওরা নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে বিরিয়ানি খেতে পারে!
 
আমাদের এইসব আছে, আমাদের সব আছে,
বিশ্বাস করো, শনিবার বড়ঠাকুর,
মঙ্গলে আজকাল ব্জরঙবলী, লাড্ডু মাস্ট,
গ্ণেশের মোদক কেমন হয় আমরা জানি,
জুম্মাবার চুম্মাবার হুক্কাবার,
গোলাপ দিন, প্রলাপ দিন
জোলাপ দিন-
শুধু আমাদের শ্যামচন্দ্র নাহি রে, শ্যামচন্দ্র কোথাও নাহি রে!
 
 
আমাদের খাদান আছে,
খাদানে জল ঢুকে যাওয়া
নিরন্তর মেঘজল এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাদের
আর তার তলায় ফুটপাথে চলন্ত বিছানা,
মাঝরাতে ছিঁড়ে নেওয়া ফুটন্ত ফুল-
আমাদের ভুলগুলো,
পরবর্তী ভুলের জন্যে অবিচলিত অপেক্ষা-
ট্রেন মিস করা
বারবার ট্রেন মিস করা-
শুধু আমাদের শ্যামচন্দ্র নাহি রে, শ্যামচন্দ্র কোথাও নাহি রে!
 
 
আমাদের পলিগ্রাফ টেস্ট আছে,
তার প্রস্তুতির জন্যে আমরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যে বলে চলি অনবরত,
তারপর আয়না ভেঙে দিই, আর আমাদের আয়না লাগে না,
পরপর শুনানির ডেট পেরিয়ে যায়,
আমরা প্যাঁচার ঘুম দেখে বেজায় হাসি,
আর হাসতে হাসতে টুক করে বেরিয়ে আর দুটো বডি পাচার করে আসি,
আমাদের বৃন্দাবনের কুঞ্জপথ জুড়ে শুধু লাশ আর লাশ
বিক্রি হবার অপেক্ষায় থাকে,
একটি লাশের পায়ের নূপুর দেখে আমাদের হেঁচকি ওঠে,
আর হেঁচকি তুলতে তুলতেই আমরা গাই
হায় আমাদের শ্যামচন্দ্র নাহি রে,
কোথাও নাহি রে!
 


 

শারদীয় সংখ্যা ১৪৩১|| বিভাবসু

 


কয়েকটি পাপীকবিতা || বিভাবসু

পাপ

চোঁয়ানো অন্ধকার ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে
যেন দেবীভীষণা তাঁর সব ধ্বংস নিয়ে,
মারি ও মড়ক নিয়ে
গ্রাস করছেন আমাদের দেশ ও কাল

সব শুভ ও সুনীতিকে গোগ্রাসে গিলে নিয়ে
তিনি, সেই মহীয়সী
রচনা করছেন রাজকীয় সন্ত্রাস
আবিল ধ্বংসচিত্র

তিনি দুর্মতি আর দুর্নীতির কাঁধে ভর করে
দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আসমুদ্রহিমাচল
অর্ধচন্দ্রখচিত তাঁর দম্ভপতাকা
দেবী নিশাচরী, লোলজিহ্বা  
আপৃথিবী ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁর ক্রোধাগ্নি
লোভের ফার্নেস জ্বালিয়ে
গ্রাস করছেন আমারই আয়ু ও আয়ুধ
প্রায় নির্জীব হয়ে আমরা পালন করছি
তার সব ভ্রান্ত অভিলাষ
বিনাশযাত্রায় গায়ে মাখছি তেজস্ক্রিয় অন্ধকার

আমার মাটি এখন দূষিত
আমাদের মানুষেরা ভ্রষ্ট
আমাদের মাটি আজ অহল্যা

আমরা আজ শয়তানশাসিত



একটি রাজনৈতিক সভার ধারাভাষ্য

মিথ্যে আলোয় উদ্ভাসিত হওয়া মঞ্চে
মিথ্যের উজ্জ্বল্যে প্রণত কিছু ধুরন্ধর
মিথ্যের মাধুর্যে উজ্জীবিত কিছু উজবুক
কিছু স্তাবক  
কিছু প্রতারক
কিছু ধর্ষকামী
কিছু ধ্বজাধারী
কিছু মিনমিনে
কিছু তালেবর
শয়তানের প্রশস্তি রচনায় ব্যস্ত

মিথ্যের বাগ্মিতায় জেগে ওঠা কিছু শ্বাপদ
মিথ্যের ভেলকিতে আশান্বিত কিছু ধুরন্ধর
মিথ্যের আশীর্বাদস্নাত কিছু চামচে
কিছু ধামাধরা
কিছু অপরিণামদর্শী
কিছু ইতর
কিছু খুনি
কিছু সুযোগসন্ধানী
কিছু বোকা
সম্মোহিত হয়ে শুনছে সেই ধ্বংসকথা

মিথ্যে আলোয় আলোকিত এক নরপিশাচ  
দারুন নৈপুণ্যে
মানুষের রক্তে মিশিয়ে দিচ্ছে বিষ
মানুষের মস্তিষ্কে পরিয়ে দিচ্ছে শিকল

আর চারদিকে ম-ম করছে জয়ধ্বনি



দুর্গতি

এরপরও তার মুখ থেকে অসংখ্য মুখোশ খুলে পড়বে
সব মুখোশই নানা কিসিমের মিথ্যে দিয়ে আঁকা
সব মুখোশ এর থিম—‘মানবতাকে হত্যা করে জয়োল্লাস'

তারপর আমরা সেই কুৎসিত মুখোশগুলো নিয়ে
একটা মিথ্যেসাথীর হাট চালু করতে পারব
যাতে পৃথিবীর সব মুখোশধারীরা এসে পছন্দমত
মুখোশ সংগ্রহ করতে পারে

আমরা মনে করি মিথ্যেবাদীরাও মানুষ
তাদেরও এই স্বাধীনতা আছে, ইচ্ছেমতো মুখোশ কেনার বা পরার
এই মৌলিক অধিকারে কেউ বাধা দিতে পারে না
যে বা যারা বাধা দেবে
তাদের কালো হাত ভেঙে দিতে আমরা দ্বিধা করব না
এ ব্যাপারে আমাদের পেয়াদারা সদাজাগ্রত

এরপর উপজাত হিসেবে প্রাপ্ত ভাঙ্গা হাতগুলিকে
জড়ো করে আমরা একটা জ্যান্ত ভাস্কর্য বানাবো তার না দেবো—
‘ন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ’
যাতে প্রতিবাদ করতে কেউ আর হাত তোলার সাহস না পায়

আমরা ধর্ষিতাকেও ফাঁসি দিয়ে প্রমাণ করব যে—
ফাঁসি পাওয়ার অধিকার সবারই আছে

আমরা কেউ চাই

আমাদের এও চাই আরো ফাঁসুরেদের  চাকরি দিতে
কারণ তারাও তো মানুষ
বাড়িতে তাদেরও বউ-বাচ্চা আছে



পাপাচারী

আরো অবারিত হয়েছে পাপ
পাপের ফসলে গোলাঘর উপচে পড়ছে
লক্ষ্মীর ভাড়ার থেকে অলক্ষ্মীর খেলাঘর পর্যন্ত
হে অপুংষক, হে অযোনী
তুমি কি অন্ধত্বের ক্ষয়রোগা ঠিকাদার হয়ে উঠেছ
না হলে মানুষের চারদিকে কীভাবে
রচনা করছ লোভের উঁচু-উঁচু গার্ডরেল?
নিজেকে লুকাচ্ছে দম্ভের আড়ালে?
আর প্রতিবাদীর দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে টিয়ার গ্যাসের শেল
জলকামানের ফোয়ারায় ধুয়ে ফেলতে চাইছ
নিজের সমস্ত নৃশংসতা
নীতিহীনতার চূড়ায় উঠে
বিনাশ করছ মানবতার চৌহদ্দি

বিনাশ কাল সমাগত বলে তুমি
তুমি হে দানবী
তুমি হে পুঁতিগন্ধের দেবী
জন্ম দিচ্ছ জারজ অভিব্যক্তি
আর সেই ইশারায়
আরো আরো অবারিত হচ্ছে পাপ
পাপশালা জমজমাট হয়ে আছে
আদি গঙ্গার তীরে



পৈশাচিক

যে নিরুৎসাহ মাঝে মাঝেই আমাকে গ্রাস করে
আমাকে দুর্বিপাকে ফেলে
তার অন্দরমহলে ঢুঁ মেরে দেখি
পচাগলা লাশের পাহাড় জমেছে
দেবী পাপময়ী বসে আছেন শর্পাসনে
দম্ভী, পিশাচাশনে

পুঁতি গন্ধে গুলিয়ে ওঠছে গা
এই সাম্রাজ্যের কোথায়ও আর শুভাচার নেই
মানবিক অভিমুখ নেই
শুধু হত্যাযজ্ঞ, যেন কয়েকশো চেঙ্গিস খাঁ-র সম্মিলিত তাণ্ডব এই

মাঝে মাঝে, ঝাঁকে ঝাঁকে আত্মহত্যারা আসে আমাকে কুরে কুরে খায়
আর প্রতি মুহূর্তে ছিবড়ে করে হৃদয়

হায়! মৃত্যুও এখানে মাফিয়া নিয়ন্ত্রিত
যেন  সুস্বাদু মাংসপিণ্ডে মহাভোজ
তাতে কেউ মিশিয়ে দিয়েছে বিষ
আমি বিষাক্ত শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করি
প্রতিবারই ব্যর্থ হই
তবে প্রতিবারই যে হব এমনটা ভাবার কিছু নেই

এবার পিশাচতন্ত্রের পরাজয় নিশ্চিত...




শারদীয় সংখ্যা ১৪৩১||পল্লববরন পাল

 

 

মহাকাব্য নির্মাণ  || পল্লববরন পাল

আমার রক্তের ঘাম
এবং ঘামের রক্ত
মিশে যাচ্ছে কলমের নিবে
আর নিব ক্রমশ বদলে যাচ্ছে
ধারালো নখে
আমার শান্ত বৌদ্ধ চোখের
কালো মণিবৃত্তে
রক্ত আঁচড়ে লেখা হচ্ছে
উই ওয়ান্ট জাস্টিস
দৃষ্টির যমজ ঘুঁষিতে ভেঙে পড়ছে
ন্যায় নীতি ধর্মের সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক অপইতিহাস   

জ্যোৎস্নাকে ডেকে বলি -
তোমার এখন কাজ বুকআকাশকে নরম রাখা
ফুলকে বলি -
ফোটো মগজবৃক্ষে
সুগন্ধ ছড়িয়ে দাও শিরাপথেপথে
তোমাদের ঘামরক্তে আর রক্তঘামে
আমার কলম তরোয়াল হয়ে নামবে কুরুক্ষেত্রে
আর নাকের অন্ধকারে ঢুকে
শয়তান শিকনিদের টেনে বের করে
ধারালো নিব-নখের ডগায় রেখে
পট করে ছুঁড়ে ফেলে

মহাকাব্য লিখবে অচিরেই

 

শারদীয় সংখ্যা ১৪৩১|| ঋতবৃতা মুখোপাধ্যায়

 


রবীন্দ্রনাথের প্রেমচেতনা ও প্রথম প্রেম ।। ঋতবৃতা মুখোপাধ্যায়
 

"তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি

        শত রূপে শত বার

জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।

    চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়

        গাঁথিয়াছে গীতহার,

    কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,

        নিয়েছ সে উপহার

জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।"


অনন্ত প্রেমের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনটি বিষয়বস্তু বারবার তাঁর রচনায় ফিরে ফিরে এসেছে, সেগুলো হলো পূজা, প্রেম আর প্রকৃতি। কিন্তু অধ্যাত্মিকতার কথা মনে রাখলে লক্ষ্য করা যায় যে, বয়স যতো বেড়েছে, ততোই তিনি আনুষ্ঠানিক ধর্ম থেকে সরে গিয়ে মানুষের ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। গানে তিনি বার বার নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বরের কাছে আশ্রয় এবং সান্ত্বনা খুঁজেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁকে যদি কোনো বিশেষ ধরনের কবি অথবা শিল্পী বলে চিহ্নিত করতেই হয়, তাহলে সম্ভবত প্রেমের কবি অথবা প্রেমের শিল্পী বলেই নাম দিতে হয়। কারণ প্রেম কেবল তাঁর শত শত প্রেমের গান আর কবিতায় প্রকাশ পায়নি, তাঁর "প্রকৃতি" এবং "পূজা"ও প্রেমের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। তাঁর বেশিরভাগ গানে এই তিন ধরনের বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করে আলাদা করা যায় না, তবে একথা সর্বজনবিদিত যে, রবীন্দ্রনাথের প্রেমে দেহের তুলনায় মানসিক এবং আধ্যাত্মিক যোগাযোগ ছিলো অনেক বেশি।

রবীন্দ্রনাথের প্রেম-চেতনার কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে আসে তাঁর গানের কথা। গীতবিতান এর "প্রেম" পর্যায়ে মোট ৩৯৫ টি গান আছে, তার মধ্যে ২৭ টি গান "গান" উপপর্যায়ে এবং বাকি ৩৬৮ টি গান তিনি নিজেই আলাদা করে একটি উপপর্যায়ে রেখেছেন, যার নাম দিয়েছেন "প্রেম বৈচিত্র্য"।

মানবজীবনের প্রণয়-অনুভূতি প্রকাশের এক মর্মস্পর্শী মাধ্যম হলো গান। প্রেমের ভাষা মুখের কথার চেয়েও গানের ভিতর দিয়ে অনেক বেশি অভিব্যক্ত হয়। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনেও তাই গানের মাধ্যমে প্রেমের অনন্য অনুভূতি সর্বাধিক পরিব্যক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানের একটি মুখ্য বিশেষত্ব হল তার বেদনায় — বিরহবেদনার দুঃসহ অশ্রুস্রোত যেন কবির প্রেমের গানগুলিকে আগাগোড়া পূর্ণ করে রেখেছে। অধিকাংশ গানে কান পাতলেই এক বিচ্ছেদবিরহের রাগিনী শোনা যায়। সারাজীবনের যে অন্তহীন শোক, বিরহ, বিচ্ছেদের গভীর বিলাপ কবিকে বেষ্টন করে রেখেছিল, রবীন্দ্র-গানের ছত্রে ছত্রে তারই আভাস পাওয়া যায়। কয়েকটি গানের কথা উল্লেখ করলেই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে...
"কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে— ",
"তবু   মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে",
"ফুল তুলিতে ভুল করেছি প্রেমের সাধনে",
"আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়",
"বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে",
"যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম"
... প্রভৃতি আরো অসংখ্য প্রেমের গানে বেদনাবিধুর অনুভূতিই বারবার প্রকাশ পেয়েছে।

 কবির জীবনে কিশোর বয়স থেকে যাঁরা প্রেমের প্রদীপ জ্বালিয়ে গেছেন তাঁদের কবি "আপন মানুষের দূতী" এবং "প্রত্যক্ষের পিছনে থাকা চির-আগন্তুক বঁধুর দূত" বলেছেন। সব সাধারণ মানুষের মতোই বিশ্বকবির জীবনেও প্রেমের প্রথম অনুভূতি "অধরা মাধুরী"র মতো ধরা দিয়েছে অনিবার্য ভাবেই। কৈশোর কালের সেই অব্যক্ত ভালোবাসা প্রথম প্রেমের শিহরণ কেমন ভাবে ধরা দিয়েছিল কবির জীবনে?  

সংগীত সৃষ্টির প্রাথমিক লগ্ন থেকে ব্রাহ্মসমাজের নিয়মিত অনুষ্ঠানের প্রেরণায় ব্রহ্মসংগীত রচনার পাশাপাশি তাঁর কৈশোরের নিভৃত শিল্পীমানসে হৃদয়বৃত্তির সূক্ষ্মতম তরঙ্গাঘাত সুরে সুরে ঝংকৃত হয়ে গান রূপে উৎসারিত হয়েছে। তাই, তাঁর অপরিণত কৈশোর ও যৌবনকালে রচিত প্রেমসংগীতগুলিতেই তৎকালীন হৃদয়াবেগের পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। কিশোর বয়সে রচিত "কবিকাহিনী" (১৮৭৮, নভেম্বর), "বনফুল" (১৮৮০, মার্চ), "ভগ্নহৃদয়" (১৮৮১, জুন), "রুদ্রচন্ড" (১৮৮১, জুন), "নলিনী" (১৮৮৪, মে), "মায়ার খেলা" (১৮৮৮, ডিসেম্বর) প্রভৃতি নাট্যসৃষ্টিগুলির বিষয়বস্তু নরনারীর অস্ফুট ভাবোদ্বেল প্রণয়।

রবীন্দ্রনাথের সতের বছর বয়সে রচিত "কবিকাহিনী" (১৮৭৮, নভেম্বর) কাব্যগ্রন্থে কবি ও তাঁর প্রেমপাত্রী "নলিনী"র অব্যক্ত প্রেমবেদনার প্রকাশ দেখা যায়।
"এখনও বুকের মাঝে রয়েছে দারুণ শূন্য
সে শূন্য কি এ জনমে পুরিবে না আর?
মনের মন্দির-মাঝে প্রতিমা নাহিক যেন
শুধু এ আঁধার গৃহ রয়েছে পড়িয়া।"

"কবিকাহিনী" কাব্যগ্রন্থ অনুযায়ী কবি ও নলিনীর প্রণয় বিঘ্নহীন অনায়াস হয়নি। অন্তরের অনির্বচনীয় বেদনায় কবি বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছেন, কিন্তু ততোধিক অশান্তিতে অন্তরে নলিনীর স্মৃতি বহন করে মুমূর্ষু নলিনীর কাছে প্রত্যাবর্তন করেছেন। কবিকাহিনীর নায়ক কবি, কাছে থাকার সময় নলিনীর প্রেম অনুভব করেনি। কিন্তু দূরে গিয়ে তার কাছে সেই প্রেম প্রতিভাত হয়েছে। "রবিচ্ছায়া"র একটি গানের কথা উল্লেখ না করলেই নয়...

"কত দিন একসাথে ছিনু ঘুমঘোরে,
তবু জানিতাম নাকো ভালোবাসি তোরে ।
মনে আছে ছেলেবেলা     কত যে খেলেছি খেলা,
কুসুম তুলেছি কত দুইটি আঁচল ভ’রে ।
ছিনু সুখে যতদিন   দুজনে বিরহহীন
তখন কি জানিতাম ভালোবাসি তোরে !
অবশেষে এ কপাল ভাঙিল যখন,
ছেলেবেলাকার যত ফুরালো স্বপন,
লইয়া দলিত মন হইনু প্রবাসী—
তখন জানিনু, সখী, কত ভালোবাসি ।।"

"ভগ্নহৃদয়" (১৮৮১, জুন) কাব্যগ্রন্থে এই গানটি কবি ও নলিনীর পুনর্বার সাক্ষাৎকালে নলিনীর কন্ঠে আছে। "ভগ্নহৃদয়" কবির বিলাতবাসকালে রচিত এবং দেশে ফিরে সমাপ্ত হয়। এই গানের অনুভূতি তাঁর একাধিক নাটকে যেভাবে ঘুরে-ফিরে দেখা গেছে তাতে সংকোচ-সতর্কভাবে একটি প্রশ্ন মনের মধ্যে নাড়া দেয়, এই গভীর প্রেমের কাব্যিক অনুভূতি কি কবির ব্যক্তিগত জীবনের কোনো অনুভূতির সঙ্গে জড়িত?

রবীন্দ্রনাথের বাস্তব জীবনের সঙ্গে এই "নলিনী"র যোগাযোগ কতখানি তা একটু দেখে নেওয়া যাক।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যারিস্টারি পড়ানোর জন্য কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথকে বিলেতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। রবীন্দ্রনাথ সতের বছর বয়সে ১৮৭৮ সালের আগস্ট মাসে মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের সাথে বোম্বাই (অধুনা মুম্বাই) আসেন এবং সত্যেন্দ্রনাথের মারাঠি বন্ধু ডঃ আত্মারাম পান্ডুরং এর পরিবারে মাস দুয়েকের জন্য গৃহবিদ্যার্থী হিসেবে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত স্পোকেন ইংলিশে ও ইংরেজি আদবকায়দায় অভ্যস্থ ও সড়গড় হওয়া। ডঃ পান্ডুরং এর সদ্য বিলেতফেরত কন্যা আন্না তড়খড় কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজি আদবকায়দায় সড়গড় করানোর এবং স্পোকেন ইংলিশে চৌখস করে তোলার। আন্না রবীন্দ্রনাথের থেকে ছয় বছরের বড় ছিলেন, তখন তিনি সদ্য বিলেত থেকে পড়াশোনা করে ফিরেছেন। শিক্ষা আদৌ কতটা হয় সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকলেও, আন্নার সঙ্গে কিশোর রবির মন দেওয়া-নেওয়ার পথ যে অচিরেই আরও প্রশস্ত হয়ে ওঠে তা বলাই বাহুল্য। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব ও কাব্যপ্রতিভায় আন্না অনুরক্ত হন। সম্পর্ক বদল হল। বিদ্যার্থী বসলেন গুরুর আসনে, আর শিক্ষয়িত্রী হলেন নবীন কবির কাব্য সংগীত সৌন্দর্যমুগ্ধ অনুরাগময়ী প্রিয়শিষ্যা। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের "কবিকাহিনী" ভারতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তার অনুবাদ আন্নাকে শোনাতেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু শুধু অনুবাদে আন্নার মন ভরে নি। প্রিয়-কবির কাব্যরস আস্বাদনের জন্য তিনি বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করেন। আন্না বলেছিলেন, "কবি তোমার গান শুনলে আমি বোধহয় আমার মরণদিনের থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।" মারাঠি তরুণী আন্না তড়খড় রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়েন। ১৭ বছরের তরুণ কবি মারাঠি তরুণীর রোমান্টিক প্রেমে সরবে না হলেও নীরবে যে সাড়া দিয়েছিলেন, তাঁর প্রমাণ মেলে যথেষ্ট। আন্না তড়খড় ভালোবেসে একটি নাম চেয়েছিলেন তাঁর কিশোর প্রেমিকের থেকে, রবীন্দ্রনাথ দিয়েওছিলেন সেই নাম - "নলিনী"। বলা বাহুল্য, "নলিনী" নামটি রবীন্দ্রনাথের খুবই প্রিয় ছিল। কবির প্রথম জীবনে রচিত বহু কাব্য-কবিতায়-নাটকে এই নামের উল্লেখ পাওয়া যায় সেই কারণেই। আন্নার জন্য কবি কাব্যের ‘গাঁথুনি’তে রচনা করেছিলেন- "শুন নলিনী খোল গো আঁখি" এই গানটি। অচেনা মহল থেকে আপন মানুষের যে দূতী এসে প্রথমে কবির হৃদয় দখলের সীমানা বড় করে দিলেন- তিনি নিঃসন্দেহে আন্না।

কত ছুতো করেই না তিনি কবির কাছে আসতেন। কবিকে বিমর্ষ দেখলে দিতেন সান্ত্বনা। আর প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে জড়িয়ে চোখ টিপে ধরতেন। পরে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন দিলীপ কুমার রায় কে  (তীর্থংকর গ্রন্থে) - "আন্না বলে বসলেন- ‘আহা কী এতো ভাবো আকাশ পাতাল’। অথবা কখনও বা প্রস্তাব পেশ করতেন, 'আচ্ছা আমার হাত ধরে টানোতো, টাগ-অফ-ওয়ারে দেখি কে জেতে?' শেষে একদিন বলে বসলেন আচমকা, ‘জানো কোন মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার।’ আর তারপর আন্না রবীন্দ্রনাথের আরাম কেদারাটিতে ঢলে পড়লেন নিদ্রাবশে। এক সময় কপট নিদ্রা ভাঙলো। করুণ বিপদে নয়ন পল্লব সিক্ত করে আন্না দেখলেন- তার দস্তানা দুটি তার হাতেই আছে, কেউ চুরি করেনি।" কবির লজ্জা কুণ্ঠা স্বভাব আর ভীরুতা এগোতে দেয়নি তাঁকে প্রেমের অনুচ্চারিত পথে। হায় ভীরু প্রেম! কবি তখন আন্নার প্রেমকে স্বীকার করে সাড়া দিতে না পারলেও কিন্তু কখনও ভোলেননি তাঁকে। আন্নার সঙ্গে কবির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল মাত্র এক মাসের সামান্য কিছু বেশি সময়, জানা যায় পরে বহুদিন তাঁর সঙ্গে কবির যোগাযোগ ছিল পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে। প্রথম প্রেমের প্রথম কদমফুলের সেই শিহরণ নিয়েই কবি জাহাজে করে বিলাতের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন ১৮৭৮ সালে। সেইসময় তরুণ রবীন্দ্রনাথের কাছে না হলেও পরিণত বয়সে এবং জীবনসায়াহ্নে এসে সেই প্রেম কবির কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব ও স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯২৭ সালের ১লা জানুয়ারি অতুলপ্রসাদ সেন ও দিলীপ কুমার রায়ের সঙ্গে আলাপচারিতায় কবি আন্নার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সেইসব কৈশোর স্মৃতিচারণ করেন। সেই কথোপকথনে আন্নার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "এ কথা আমি মানবো যে আমি বেশ টের পেতাম যে ঘটবার মতো একটা কিছু ঘটছে, কিন্তু হায়রে! সে হওয়াটাকে উস্কে দেবার দিকে আমার না ছিল কোনও তৎপরতা, না ছিল কোনও প্রত্তুৎপন্নমতিত্ব।" শেষ বয়সে এসে কবির "পশ্চিমযাত্রীর ডায়েরি"তে স্মৃতিচারণার অংশে তিনি বলেছেন, "কিশোর বয়সে যারা আমাকে কাঁদিয়েছিল, হাসিয়েছিল, আমার কাছ থেকে আমার গান লুঠ করে নিয়ে ছড়িয়ে ফেলেছিল, আমার মনের কৃতজ্ঞতা তাদের দিকে ছুটল। তারা মস্ত বড়ো কিছুই নয়; তারা দেখা দিয়েছে কেউ বা বনের ছায়ায়, কেউ বা নদীর ধারে, কেউ বা ঘরের কোণে, কেউ বা পথের বাঁকে। তারা স্থায়ী কীর্তি রাখবার দল নয়, ক্ষমতার ক্ষয়বৃদ্ধি নিয়ে তাদের ভাবনাই নেই; তারা চলতে চলতে দুটো কথা বলেছে, সব কথা বলবার সময় পায় নি; তারা কালস্রোতের মাঝখানে বাঁধ বাঁধবার চেষ্টা করে নি, তারই ঢেউয়ের উপর নৃত্য করে চলে গেছে, তারই কলস্বরে সুর মিলিয়ে; হেসে চলে গেছে, তারই আলোর ঝিলিমিলির মতো। তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললুম, "আমার জীবনে যারা সত্যিকার ফসল ফলিয়েছে সেই আলোর, সেই উত্তাপের দূত তোমরাই। প্রণাম তোমাদের। তোমাদের অনেকেই এসেছিল ক্ষণকালের জন্য আধো-স্বপ্ন আধো-জাগার ভোরবেলায় শুকতারার মতো। প্রভাত না হতেই অস্ত গেল। মধ্যাহ্নে মনে হল তারা তুচ্ছ; বোধ হল, তাদের ভুলেই গেছি। তার পরে সন্ধ্যার অন্ধকারে যখন নক্ষত্রলোক সমস্ত আকাশ জুড়ে আমার মুখের দিকে চাইল, তখন জানলুম সেই ক্ষণিকা তো ক্ষণিকা নয়, তারাই চিরকালের; ভোরের স্বপ্নে বা সন্ধ্যাবেলার স্বপ্নাবেশে জানতে না-জানতে তারা যার কপালে একটুখানি আলোর টিপ পরিয়ে দিয়ে যায় তাদের সৌভাগ্যের সীমা নেই। তাই মন বলছে, একদিন যারা ছোটো হয়ে এসেছিল আজ আমি যেন ছোটো হয়ে তাদের কাছে আর-একবার যাবার অধিকার পাই; যারা ক্ষণকালের ভান করে এসেছিল, বিদায় নেবার দিনে আর-একবার যেন তারা আমাকে বলে 'তোমাকে চিনেছি', আমি যেন বলি, 'তোমাদের চিনলুম'।"



তথ্যসূত্র : 


১) বাংলা কাব্যসংগীত ও রবীন্দ্র সংগীত  — ড. অরুণকুমার বসু
২) রবীন্দ্র সংগীত — শান্তিদেব ঘোষ
৩) তীর্থংকর — শরীর দিলীপকুমার রায়
৪) পশ্চিমযাত্রীর ডায়েরি (রবীন্দ্র রচনাবলী) — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৫) রবীন্দ্র গানের অন্তরালে — পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার



শারদীয় সংখ্যা ১৪৩১|| বিশ্বজিৎ রায়

 

 

আমার কবিতাবাড়ি || বিশ্বজিৎ রায়

 
এ যাবত যাকিছু লিখেছি তার ভূমি পরীক্ষা করা হোক---

ভিত গড়ার আগে কতদূর  খনন করা হয়েছে

নতুন-পুরানো ক’হাজার পুঁথি  গেঁথে ভিত রচিত হয়েছে ,

কতো পরিমাণ  বঞ্চনা, অবজ্ঞা, অবহেলা,

ক্ষতচিহ্নের নুনজলে মিশিয়ে

গড়ে তোলা হয়েছে এই কবিতাবাড়ি,

তার ঘর, বারান্দা, ছাদ, আসবাব, সব দেখা হোক  …

 

সব ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে  মূল্যায়ন করা হোক,

আমার মৃত্যুর পর এর বাজার মূল্য কতটা থাকবে,

যথাযথ সম্মানে বিকোবে কিনা  ---

নাকি, অন্য অনেকের  মতো সব ধুলিস্যাত হয়ে

স্মৃতির অতলে চলে যাবে চোখ বুজতে না বুজতেই !

 

সেসব খুব দ্রুত  পরীক্ষা করে আমাকে জানানো হোক ---

সেই বুঝে আমি সীদ্ধান্ত নেব, এই কবিতাবাড়ি আমি

অক্ষত রেখে  যাব,  নাকি আত্মঘাতি বিস্ফোরণে

উড়িয়ে দিয়ে যাব নিজেই, নিজের মৃত্যুর আগে...

 

 

শারদীয় সংখ্যা ১৪৩১|| রিতা মিত্র

 

লেনিয়াদ্রি গুহা || রিতা মিত্র


এবারে আমার যাত্রা ছিল মহারাষ্ট্রের পশ্চিম ঘাট। যার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অন্য মাত্রার ।বিশেষ করে বর্ষার মরশুমে।
আরব সাগরের হাওয়া এসে এই পাহাড়ের গায়ে আটকে যায় ফলে বৃষ্টির পরিমাণ খুব  এবং পাহাড়ি অঞ্চল বলে পাহাড়ে গা বেয়ে হাজার জলধারা নেমে আসে। এই অঞ্চলকে থাউজেন্ড সিস্টার ফল বললে কম বলা হয়।
আমরা যাব লেনিয়াদ্রি গুহা। এই জায়গা গণেশ গুহা বা গণেশ পাহাড় বলে খ্যাত।
কেননা পাহাড়ের এক গুহায় গণেশ দেবের পুজো হয়ে থাকে।
লেনিয়াদ্রি গুহা মহারাষ্ট্রের পুনে জেলার জুন্নার শহরের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এখানে পাহাড় কেটে প্রায় তিরিশটি গুহা নির্মাণ করা হয়। ইতিহাসবিদ দের কথায় এর নির্মাণ কাল প্রথম শতাব্দী থেকে তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে।
মুলত এই গুহাগুলি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কিন্তু সাত নম্বর গুহাটি হিন্দুদের দখলে চলে যায় এবং এখানে গণশের অষ্টবিনায়ক মূর্তি পূজো আরম্ভ হয়। গণেশ পুরাণ এর মতে দেবি পার্বতী বারো বছর তপস্যা করে গণেশকে পুত্র রুপে পান।
       এখানে প্রবেশ মুল্য পঁচিশ টাকা। গাড়ি পার্কিং আলাদা। গুহায় উঠছে ৩৩৮ টি খাড়াই সিঁড়ি উঠতে হবে। বৃষ্টির জলে বেশ পিচ্ছিল থাকে। বয়স্কদের জন্য ডুলির ব্যবস্থা আছে হাজার টাকা মাথা পিছু। আমিও ডুলিতে উঠে বসলাম। কেননা আগের দিন প্রচুর হাঁটাহাঁটি করে সাড়ে চারশ সিঁড়ি বেয়ে ঘুরে কোমরে হাঁটুতে খুব ব্যথা হয়েছে।


চারজন মিলে ডুলি বয়ে নিয়ে চলল জোর কদমে। আমি ভয়ে মরেই যাই এত জোরে ছুটছে সিঁড়িতে যদি ওদের পা পিছলে যায় তবে আমার স্বর্গের টিকিট পাকা।
প্রায় দুশো সিঁড়ি উঠে একবারে জন্য বিশ্রাম তাও দু মিনিট এর জন্য আবার সেই দৌড়। একেবারে অষ্টবিনায়ক মন্দির সামনে নামাল।। বৃষ্টি ছিলনা বলে এতটা পথ শুকনো এসেছি কিন্তু আর উপায় নেই। মন্দিরে প্রবেশ করতে হলে গুহায় যেতে হবে আর পাহাড়ের গা বেয়ে সহস্র ধারার মতো জল পড়েই যাচ্ছে ক্রমশ।
সিঁড়ি ওঠা শেষ হয়েও হল না। আরো দশ বারোটা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। আর সিঁড়ির ধাপ এত উচুঁ যে হাঁটু কপালে  ঠেকে যাবার জোগাড়। কোনো মতে বসে বসে একধাপ একধাপ করে উঠে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। বিশাল এক নাথ মন্দিরের মতো জায়গা। প্রায় দেড়শ লোক এটে যাবে এক সাথে। পাথরের মেঝেতে অনেকে বসে আছেন হাত জোড় করে। একদিকে পুরুত মশাই পূজো দিয়ে যাচ্ছেন। প্রবেশ পথের পিলারে হাতি সিংহের মূর্তি পাথর কেটে করা আছে। ভেতরে ছবি তোলা বারণ। তাই বায়রনের ছবি তুললাম। 

আবার নেমে একটি কক্ষে প্রবেশ করলাম। এখানে কোনো মূর্তি নেই। একটি মঙ্গল কলস পাথর কেটে তৈরি করা যা মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিশাল। অনেক গুলি পাথরের থাম রয়েছে কক্ষ জুড়ে।
বাইরে বেরিয়ে পাশের গুহাগুলি দেখতে যেতেই সবাই বলল ওগুলো তালা বন্ধ
। তাও এগিয়ে গেলাম। লক্ষ করলাম সেগুলো বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধ্যান কক্ষ। বাকিগুলো সত্যি তালা বন্ধ। এত উপরেও প্রাচীন কালে জল ধরে রাখার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বৃষ্টির জল পাহাড় বেয়ে এই পাথরের কুণ্ড গুলোতে জমা হত। যা সারা বছর ধরে ব্যবহার করা হত।
এখানে দাঁড়িয়ে জুন্নার শহরের অনেকটা দেখা যায়। প্রচুর গাছপালা চারিদিকে। বর্ষার ছোঁয়া পেয়ে নব যুবতীর মতো খিলখিল হাসছে। কত পাখির গান শুনলাম। পথের ধারে পাহাড়ি সিঁড়ির উপরে কোথাও কোথাও বাঁদর বাবাজীরা সদলবলে বসে আছেন। অনেকে কলা আপেল খেতে দিচ্ছে। কিন্তু বাঁদর বাবাজীরা জলের বোতল দেখলেই হামলে পড়ে কেড়ে নিচ্ছে। আমাদের দলের সর্বকনিষ্ঠ যাত্রী ঈশিতার জলের বোতল তারা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিয়েছে।
ডুলি করে আবার নেমে এলাম। আমরা তিনজন ডুলি করে গিয়েছিলাম।যখন নামছি তখন দলের বাকিরা উঠছে।  তাদের অর্ধেক পথ বাকি।
নিচে নেমে দোকান থেকে প্রসাদ কিনলাম। লাড্ডু প্রসাদ দুটো তিরিশ টাকা।
এক কাপ চা নিয়ে বাকিদের নেমে আসার অপেক্ষা সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম।