মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা , ১-ম বর্ষ , ২৮১-তম প্রয়াস
পঁচিশে ডিসেম্বর সুজান মিঠি
-- ‘এ মা, মা ওঠ না, বল না ওই বুড়ো দাদুটা কখন আসবে আমাদের ফুটপাতে?’
-- ‘আঃ, মুন্নি, ঘুমোতে দিবি শান্তিতে! চুপ মেরে শো। কে দাদু, কখন আসবে, ওসব কাল সকালে ভাববি। নে, শুয়ে পড় দিকিনি।’
-- ‘এ মা, ফের ঘুমাই গেলি, শোন না, ওঠ না মা একটিবার, খুব শীত লাগছে মা, তোর আঁচল টা এত ছেঁড়া কেনে মা! একটু গরম বাঁধে না গায়ে।’
-- ‘এ মেয়ে তো জ্বালায় দেখি ভারী, উফ, ওই উধার পানে দেখ তোর বাপের দারুর সিসে গুলো ভরা আছে, ওই বস্তাটা টেনে নিয়ে আয় ইদিকে, আমার আঁচলের উপরে চাপিয়ে দিলে এত ঠান্ডা লাগবেনি আর।’
-- ‘এই তো আনলাম মা, উহঃ বিচ্ছিরি গন্ধ মা, তোর কাপড়ের আঁচলটাও এখন মাতাল বাপ হয়ে গেল রে। ইসস।’
নামকরা শহরের ফুটপাতে মা মেয়ের মধ্যরাতের এক সাধারণ সংলাপ। এরপর যদি সারাদিন পেট-সন্ধানী পরিশ্রমী মা ঠান্ডায় জমতে জমতে হলেও ঘুমিয়ে পড়ে, মেয়ের অবান্তর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, তবে কি আর করা।।
কিন্তু সাধারণ সংলাপের দিনটি ছিল পঁচিশে ডিসেম্বরের মধ্যরাত, তাই মুন্নির মায়ের আর ফুটপাতিয়া ঘুমটা সম্পন্ন হলো না সহজেই।
-- ‘ এই মুন্নি, কি রে ঘুমাইনিস কেনে এখনো? সেই বসে আছে হাভাতি মেয়েছেলে! কি হয়েছে রে তোর আজ বল দিকিন?’
মা ঘুমিয়ে পড়ার পরে গায়ের উপর মদের বোতল রাখার জন্য ব্যবহৃত বস্তা খান মায়ের ছিন্ন আঁচলের উপর শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে মুন্নি কাঁদতে শুরু করেছিল। গাল বেয়ে রুক্ষ চুল ভিজিয়ে সে কান্না এসে থামল মায়ের পিঠে, আর ঘুম গেল মায়ের। চাঁদের আলোয় চমকে উঠে দেখে নিল ভালো করে, ‘যাক বাবা, রক্ত নয়, কান্না।’ সড়কের চাকার ঘর্ষণ ফুটপাতে রক্ত হয়ে উঠে আসা বিশেষ আশ্চর্যের তো আর নেই তাদের কাছে।
-- ‘মা, জানিস, টেশনের নিচে বিকালবেলায় জলের বোতলগুলো কুড়ুচ্ছিলাম যখন, দেখি স্কুলের দিদিমনিগুলো বসে বসে লিস্টি করছিল বলে বলে আজ রাতে নাকি কে একজন দাদু আসবে ওদের ঘরে, কত কি দেবে ওদের, ওরা যা চাইবে তাই দেবে, এ মা, বল না কেনে ওই দাদুকে, আমাদের শুধু একটা কম্বল দিতে। এই ঠান্ডায় বড্ড কষ্ট হয় রে মা। এ মা ওই দাদুটা কে মা?’
ঘুমালু চোখে বিস্ময় তখন মুন্নির মায়েরও। কে এমন আছে যে সবার সব ইচ্ছে পূরণ করে যায় ঘুমের মধ্যে আজ? সে ভাবে, বাবুদের বাড়ির মা বউরা উপোস দিয়ে বাড়ির মানুষ দের মঙ্গল চায়, তাদের অনেক মঙ্গল হয়। টাকা হয়, খাবার হয়, পোশাক হয়। আর তারা তো নিত্যি উপোস করে ধরতে গেলে, কই তাদের তো এসব কিছু…
-- ‘এ মা বল না’
ঘোর কাটে মুন্নির মায়ের। অনেক কষ্টে বুকের মধ্যে টিপে ধরে ঘুম পাড়ায় মেয়েকে তার। তারপর নিজে জেগে থাকে সারারাত। সে বলে -- ‘ কে গা তুমি বুড়ো বাবা, কেউ কি আছো সত্যি এমনি ধারা তুমি, তবে আজ এক্ষুণি আমায় অনেক বেশি জ্বর দাও গায়ে, এত জ্বর যেন আমার মুন্নি আজকে রাতে একটু গরম গায়ে ঘুমাতে পারে। একটু গরম পায়’।
সকাল হতেই মুন্নি ঘুম থেকে উঠে খুঁজতে থাকে তার মাকে। তার মাতাল বাপ ও দেখে নাই তাকে। ভয়ে মুন্নি কাঁদতে শুরু করে। তার বাপ পাঁচুইয়ের শেষ ঢোঁকটা গলায় ঢেলে বলে-- ‘আহঃ, কাঁদিসনি মুন্নি, ওই কালু মনে হয় নিয়ে গেছে তুলে, ফের দিয়ে যাবে ভাবিসনি। খুব দেমাক মাগীর। কতবার বললুম পঞ্চাশ ট্যাকা দেবে, এক রাত্তির যা না। কিছুতেই যাবে নে। ঠিক হয়েছে নিয়ে গেছে শালীকে।’
মুন্নি এসব বোঝে এখন, বয়স দশ বা এগারো হলেও সেও যে এমন বিষ নজরে পড়েনি তা নয়। তার মা সবসময় ছুরি নিয়ে থাকে বুকে। নিজেকে আর নিজের রক্তকে বাঁচিয়ে চলে ফুটপাতে।
কিছু পরে মুন্নি কাঁদতে কাঁদতে দেখে তার মা ছুটতে ছুটতে আসছে রাস্তা দিয়ে। বগলে একটা কম্বল। ফুটপাতে ওঠার আগেই মুন্নির মায়ের শরীরটা পিষে দিয়ে গেল দুই ফুর্তিবাজ বাইক রেসারদের চাকা। ছুটে এলো মুন্নি। জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিল মায়ের রক্তাক্ত শরীর।
-- ‘ এই নে মুন্নি, তোর ওই বুড়ো দাদু এটা তোকে দিয়েছে রে বাপ। আজ থেকেন গরমে ঘুমাইবে আমার মুন্নি।’ বুকের ভিতর থেকে ছুরিটা বের করে বলে মেয়েকে, ‘এটা বড় অমূল্য রে, বুকে রাখবি কিন্তুক। বল পাবি বল।’
কম্বলটা ততক্ষনে শ্মশানের ধূপের গন্ধ ছাড়িয়ে রক্তের গন্ধে ভরপুর হয়ে গেছে। পাশের ফুটপাতের চন্দনা ভোরবেলায় ফিরছিল কালুর গা গরম আখড়া থেকে। তখনই দেখতে পেয়েছিল মুন্নির মাকে, শ্মশান ঘাটে বসে থাকতে। বড়লোক বুড়োটা পুড়বে, আর সে কম্বলটা এনে দেবে তার মুন্নিকে।
মুন্নির সান্তা বুড়ো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, মায়ের রক্ত-গন্ধে মোড়া কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে সে আকাশের উজ্জ্বল তারাটার সঙ্গে কথা বলে অনেক রাতে, --‘এ মা, জানিস তো, কালু আজ ছুরি দেখে সেকি দৌড় দিল রে, কি বলবি।
--এ মা, তুই ফিরে আয় না রে, আর কখনো বুড়ো দাদু চাইবো না।
--এ মা, আমি বুঝেছি, ওই দাদু শুধু ওই দিদিমণিদের দেখতে পায়, ফুটপাত দেখতে পায়না ।
-- এ মা ফিরে আয় না।’
ধীরে ধীরে কম্বলটা আরো বেশি গরম হয়ে ওঠে। আরামে ঘুম আসে মুন্নির চোখে।
-- ‘আঃ, মুন্নি, ঘুমোতে দিবি শান্তিতে! চুপ মেরে শো। কে দাদু, কখন আসবে, ওসব কাল সকালে ভাববি। নে, শুয়ে পড় দিকিনি।’
-- ‘এ মা, ফের ঘুমাই গেলি, শোন না, ওঠ না মা একটিবার, খুব শীত লাগছে মা, তোর আঁচল টা এত ছেঁড়া কেনে মা! একটু গরম বাঁধে না গায়ে।’
-- ‘এ মেয়ে তো জ্বালায় দেখি ভারী, উফ, ওই উধার পানে দেখ তোর বাপের দারুর সিসে গুলো ভরা আছে, ওই বস্তাটা টেনে নিয়ে আয় ইদিকে, আমার আঁচলের উপরে চাপিয়ে দিলে এত ঠান্ডা লাগবেনি আর।’
-- ‘এই তো আনলাম মা, উহঃ বিচ্ছিরি গন্ধ মা, তোর কাপড়ের আঁচলটাও এখন মাতাল বাপ হয়ে গেল রে। ইসস।’
নামকরা শহরের ফুটপাতে মা মেয়ের মধ্যরাতের এক সাধারণ সংলাপ। এরপর যদি সারাদিন পেট-সন্ধানী পরিশ্রমী মা ঠান্ডায় জমতে জমতে হলেও ঘুমিয়ে পড়ে, মেয়ের অবান্তর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, তবে কি আর করা।।
কিন্তু সাধারণ সংলাপের দিনটি ছিল পঁচিশে ডিসেম্বরের মধ্যরাত, তাই মুন্নির মায়ের আর ফুটপাতিয়া ঘুমটা সম্পন্ন হলো না সহজেই।
-- ‘ এই মুন্নি, কি রে ঘুমাইনিস কেনে এখনো? সেই বসে আছে হাভাতি মেয়েছেলে! কি হয়েছে রে তোর আজ বল দিকিন?’
মা ঘুমিয়ে পড়ার পরে গায়ের উপর মদের বোতল রাখার জন্য ব্যবহৃত বস্তা খান মায়ের ছিন্ন আঁচলের উপর শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে মুন্নি কাঁদতে শুরু করেছিল। গাল বেয়ে রুক্ষ চুল ভিজিয়ে সে কান্না এসে থামল মায়ের পিঠে, আর ঘুম গেল মায়ের। চাঁদের আলোয় চমকে উঠে দেখে নিল ভালো করে, ‘যাক বাবা, রক্ত নয়, কান্না।’ সড়কের চাকার ঘর্ষণ ফুটপাতে রক্ত হয়ে উঠে আসা বিশেষ আশ্চর্যের তো আর নেই তাদের কাছে।
-- ‘মা, জানিস, টেশনের নিচে বিকালবেলায় জলের বোতলগুলো কুড়ুচ্ছিলাম যখন, দেখি স্কুলের দিদিমনিগুলো বসে বসে লিস্টি করছিল বলে বলে আজ রাতে নাকি কে একজন দাদু আসবে ওদের ঘরে, কত কি দেবে ওদের, ওরা যা চাইবে তাই দেবে, এ মা, বল না কেনে ওই দাদুকে, আমাদের শুধু একটা কম্বল দিতে। এই ঠান্ডায় বড্ড কষ্ট হয় রে মা। এ মা ওই দাদুটা কে মা?’
ঘুমালু চোখে বিস্ময় তখন মুন্নির মায়েরও। কে এমন আছে যে সবার সব ইচ্ছে পূরণ করে যায় ঘুমের মধ্যে আজ? সে ভাবে, বাবুদের বাড়ির মা বউরা উপোস দিয়ে বাড়ির মানুষ দের মঙ্গল চায়, তাদের অনেক মঙ্গল হয়। টাকা হয়, খাবার হয়, পোশাক হয়। আর তারা তো নিত্যি উপোস করে ধরতে গেলে, কই তাদের তো এসব কিছু…
-- ‘এ মা বল না’
ঘোর কাটে মুন্নির মায়ের। অনেক কষ্টে বুকের মধ্যে টিপে ধরে ঘুম পাড়ায় মেয়েকে তার। তারপর নিজে জেগে থাকে সারারাত। সে বলে -- ‘ কে গা তুমি বুড়ো বাবা, কেউ কি আছো সত্যি এমনি ধারা তুমি, তবে আজ এক্ষুণি আমায় অনেক বেশি জ্বর দাও গায়ে, এত জ্বর যেন আমার মুন্নি আজকে রাতে একটু গরম গায়ে ঘুমাতে পারে। একটু গরম পায়’।
সকাল হতেই মুন্নি ঘুম থেকে উঠে খুঁজতে থাকে তার মাকে। তার মাতাল বাপ ও দেখে নাই তাকে। ভয়ে মুন্নি কাঁদতে শুরু করে। তার বাপ পাঁচুইয়ের শেষ ঢোঁকটা গলায় ঢেলে বলে-- ‘আহঃ, কাঁদিসনি মুন্নি, ওই কালু মনে হয় নিয়ে গেছে তুলে, ফের দিয়ে যাবে ভাবিসনি। খুব দেমাক মাগীর। কতবার বললুম পঞ্চাশ ট্যাকা দেবে, এক রাত্তির যা না। কিছুতেই যাবে নে। ঠিক হয়েছে নিয়ে গেছে শালীকে।’
মুন্নি এসব বোঝে এখন, বয়স দশ বা এগারো হলেও সেও যে এমন বিষ নজরে পড়েনি তা নয়। তার মা সবসময় ছুরি নিয়ে থাকে বুকে। নিজেকে আর নিজের রক্তকে বাঁচিয়ে চলে ফুটপাতে।
কিছু পরে মুন্নি কাঁদতে কাঁদতে দেখে তার মা ছুটতে ছুটতে আসছে রাস্তা দিয়ে। বগলে একটা কম্বল। ফুটপাতে ওঠার আগেই মুন্নির মায়ের শরীরটা পিষে দিয়ে গেল দুই ফুর্তিবাজ বাইক রেসারদের চাকা। ছুটে এলো মুন্নি। জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিল মায়ের রক্তাক্ত শরীর।
-- ‘ এই নে মুন্নি, তোর ওই বুড়ো দাদু এটা তোকে দিয়েছে রে বাপ। আজ থেকেন গরমে ঘুমাইবে আমার মুন্নি।’ বুকের ভিতর থেকে ছুরিটা বের করে বলে মেয়েকে, ‘এটা বড় অমূল্য রে, বুকে রাখবি কিন্তুক। বল পাবি বল।’
কম্বলটা ততক্ষনে শ্মশানের ধূপের গন্ধ ছাড়িয়ে রক্তের গন্ধে ভরপুর হয়ে গেছে। পাশের ফুটপাতের চন্দনা ভোরবেলায় ফিরছিল কালুর গা গরম আখড়া থেকে। তখনই দেখতে পেয়েছিল মুন্নির মাকে, শ্মশান ঘাটে বসে থাকতে। বড়লোক বুড়োটা পুড়বে, আর সে কম্বলটা এনে দেবে তার মুন্নিকে।
মুন্নির সান্তা বুড়ো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, মায়ের রক্ত-গন্ধে মোড়া কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে সে আকাশের উজ্জ্বল তারাটার সঙ্গে কথা বলে অনেক রাতে, --‘এ মা, জানিস তো, কালু আজ ছুরি দেখে সেকি দৌড় দিল রে, কি বলবি।
--এ মা, তুই ফিরে আয় না রে, আর কখনো বুড়ো দাদু চাইবো না।
--এ মা, আমি বুঝেছি, ওই দাদু শুধু ওই দিদিমণিদের দেখতে পায়, ফুটপাত দেখতে পায়না ।
-- এ মা ফিরে আয় না।’
ধীরে ধীরে কম্বলটা আরো বেশি গরম হয়ে ওঠে। আরামে ঘুম আসে মুন্নির চোখে।
No comments:
Post a Comment