কোনো এক গোধূলি বেলায়
রঞ্জনা ভট্টাচার্য
শুকনো ঘামের গন্ধ আর ধূলোট নাভি নিয়ে দিবাকর রক্তের ছোপ ধরা মেঘের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে নিচে। এইসময় নির্জন হয়ে যাই। কোলাহলে ভুগে ভুগে আমি বিষণ্ণ। ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে হুঁস করে চলে যাওয়া গাড়ি, বহুতল বাড়ির বারান্দা -বাগান দূর থেকে রূপকথা মনে হয়। আমার মধ্যমেধার হাত থেকে অক্ষরেরা পিছলে চলে যায়, তাকে বলি তোমার সিন্দুকের চাবি পেলে সিন্দবাদ হয়ে যাব। কোনো এক নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে এরোপ্লেন উড়ে চলে যায় উৎকণ্ঠা নিয়ে । তাকে চলে যেতে দেখে মনে হয় আমার কোনো উড়ান নেই। বুকের ভেতর কথা জমে জমে পাথর।কলম নিয়ে বসলেই তারা কেমন যেন বাষ্পের মতো উড়ে যায় ঐ এরোপ্লেনটার কাছে,ওর পেটের ভিতরে উৎকন্ঠার পাশে উবু হয়ে বসে আর ঝিমোয়। কলম ধমক দেয়,'বিরক্ত লাগে।সাদা পাতার উপর অকেজো আমাকে বসিয়ে রেখেছ।না পারলে লিখো না। তুমি না লিখলেও জগতের কোনো ক্ষতি নেই। আমাকে রেহাই দাও।'
আমি না লিখলে সত্যিই তো এই জগতের কিছু যায় আসেনা। আমি কি জগতের জন্য লিখি?এই জগতের জন্য তো কেয়ারি করা বাগান,ফ্লাইওভার, বহুতল ভবন নয়। এগুলো সবই মানুষের জন্য। এই জগতের জন্য সমুদ্রের নুন আর ঘাম, একরোখা পাহাড় , অকারণে উৎফুল্ল ঝর্ণা । আমি কী তাদের
জিজ্ঞাসা করব আমার লেখায় কিছু
যায় আসে কিনা! ঐ যে একটু ঝুঁকে পড়া খেজুর গাছ ও আমার অস্পষ্ট কবিতা শুনবে?
কবিতাগুলিকে তালুর উপর রেখে উল্টেপাল্টে দেখবে ওপাশের একটেঁরে মাঠ। ঢ্যাঙা তালগাছ হয়তো মাথা নাড়বে কিচ্ছুটি হয়নি ,একদম মিনিংলেস। অক্ষরেরা একটু একটু করে কুঁকড়ে যাবে ,ওদের গলা শুকিয়ে কাঠ।অ মানে' অত্যাচার' না অ মানে' অপসারণ '...অ নিজেকে অজগরের পেট থেকে একবার করে বার করবে, অজগর বিলক্ষণ আবার তাকে গিলে ফেলবে । আ তে যে 'আমি' তাকে দেখে বিস্মিত হইনি কোনোদিন? আমার ভিতরে লুকনো ঈর্ষা আর দ্বেষ,লোভ আর তামাসা চমকে দিয়েছে বারবার,আর ভেবেছি আমি বুঝি এরকম ! আমি এরকম? নিজেকে ভালবাসতে গিয়েও তো কখনও ভালবাসা ছিটকে বেরিয়ে গেছে তিরবিদ্ধ হরিণীর মতো। ভালবাসা পুরুষ না নারী এই ভাবনায় শিহরিত হয়েছি কতবার!
আমি এক গাঢ় আমি'তে বুঁদ হয়ে আছি। আমার ভিতরের আমি কি বাইরের আমিকে দেখে বিস্মিত হয় না বিপন্ন বোধ করে ? নাকি সে শুধুই সাক্ষী? তার দেখে যাওয়া ছাড়া কোন কাজ নেই।সারা গায়ে আমির ফোঁড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে অবয়ব তার থেকে সাক্ষী আমির মুক্তি আছে কিনা কে জানে?
আমি যে আমার বন্ধু হয়ে উঠতে পারিনিএকথা দুঃখ জানে বলেই প্রতিবেশীর মতো আড়ি পেতে থাকে; ফিসফিস করে কিছু কথা নিজেকে বলতে গেলেই টের পাই, সবটা বলে উঠতে পারছি না। উচ্চারিত কথা আর অনুচ্চারিত কথার মধ্যে দিয়ে ফায়ার এঞ্জিন চলে যায়। অনিশ্চয়তার আগুন নেভাতে গিয়ে কতবার স্নায়ুর মধ্যে অন্ধকার হয়ে যায়। মুহূর্তে কোনো গ্যালোপিং ট্রেন চলে যায় আলোর ঝলকানি তুলে।
যতটুকু মানায় ততটুকু দিয়েই আমি তৈরি, তবুও কেন যে সবার থেকে একটু করে টুকে নিয়ে নিজেকে বেঢপ বানাই!আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হয় কিছুটা 'নিয়তি',কিছুটা 'বৃষ্টি', কিছুটা 'কুয়াশা', কিছুটা 'সান্নাটা',কিছুটা'পতঝর'- নিয়ে তৈরি আমি আমার থেকে একটু দূরে 'তুমি'র কাছে, তুমি'র থেকে একটু দূরে 'আপনি'র কাছে....
আয়নাকে জিজ্ঞাসা করি,'আপনি কী চান?'
আয়না নিরুত্তর...
No comments:
Post a Comment