Friday, 13 October 2023

উৎসব সংখ্যা ১৪৩০ : অণুগল্প , দেবারতি দাস

 


ভালোবাসা চির অম্লান
দেবারতি দাস


টেবিলে ফল কেটে রাখা। সারা দুপুর উনকিপোকা উড়ছে তাতে। পাশ ফিরে সুয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে আছেন সুপর্বা। ছেলে, বউ আর ছোট্ট নাতি সোমু এসে ঘুরে গেছে পুজোয়। আবার বারোটা মাস!....

মণীন্দ্র গুপ্তের অক্ষয় মালবেরিটা আজ শেষ করবেন ভেবেছিলেন দীপেন্দু। ড্রইঙে বসে চোখটা লেগে গিয়েছিলো তাঁর। ভোরে নিয়মিত হাঁটা, বাজারের নেশা, ফিরে এসে স্নান-খাওয়া, বিকেলে সমবয়সী আড্ডা তারপর বই আর খবরের চ্যানেল -- এইসবের মধ্যে দিয়েই অবসর দিব্যি কেটে যাচ্ছে দীপেন্দুর.. কিন্তু যৌবনের উচ্ছ্বসিত সুপর্বা মোহনায় এসে বড়ো শান্ত, নিস্তরঙ্গ, উদাসীন।....

দীপেন্দু ও সুপর্বার একমাত্র ছেলে নীলেন্দু লন্ডনে সেটেল্ড্। তিন বছরের নাতি সুপর্বার কোলের বদলে বেড়ে উঠছে বিদেশে। ভিডিও কলে ওদের প্রি স্কুলের প্রোগ্রাম দেখেছেন সুপর্বা। সাদা সাদা বাচ্চাগুলোর মধ্যে একেবারে মিশে গেছে ওনাদের সোমু, সৌমেন্দু দত্ত, দত্তদের বংশ প্রদীপ। সোমুর জন্ম ওই দেশেই। সেই সময়ে বউমা তনিমার মা ওখানে ছিলেন প্রায় ছয় মাস। সুপর্বা এরোপ্লেনে অতক্ষণ কিছুতেই বসতে পারবেন না। বহুবার টিকিট কেটেও শেষ পর্যন্ত ওনার যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সুপর্বাকে একা রেখে দীপেন্দুও ছেলে-বউমার সংসার দেখতে যেতে পারেননি। সোমুর দুই বছর বয়সে ওঁরা দেশে আসেন, আবার এইবার পুজোয়। নতুনভাবে পুজোর দিন গোনার এই বয়সে এসেও একটা কারণ পেয়েছেন সুপর্বা, নামের মতোই তাঁর বেঁচে থাকাটাও অর্থবহ হয়ে ওঠে বছরের ওই কটা দিন।....

দীপেন্দু ধীরে ধীরে শোয়ার ঘরে যান। চিরকালীন জ্যাসমিন তেল আর বোরোলিনের গন্ধ মিলেমিশে সুপর্বার চির পরিচিত ঘ্রাণ। বড়ো ভালো নাচতেন সুপর্বা। আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে চল্লিশ বছর আগে কলেজের রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান -- "গহন স্বপন কুঞ্জ মাঝে" নাচের তালে সুপর্বা আর বেতাল দীপেন্দুর মন!....

এগিয়ে গিয়ে সুপর্বার মাথার কাছে বসেন দীপেন্দু। "যাবে আজ? গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি, আরও একটা সূর্যাস্তের সাক্ষী থাকি দুজনে"। কলেজের দিনগুলো থেকেই দীপেন্দু জানেন, সুপর্বার বড়ো ভালো লাগে গঙ্গার ঘাট, সূর্যাস্তের রঙ।.... পাশ ফিরতে গিয়েও কেমন যেন অনিচ্ছা ঘিরে ধরলো তাঁকে। হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে। আবার শাড়ি ছাড়া, সাজগোজ যেইটুকু না করলেই নয়।.... দীপেন্দু এবার উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা হালকা গোলাপি রঙের বাটিকের শাড়ি বের করে দিলেন.. "এই রঙের আমারও একটা পাঞ্জাবি আছে না?".... সুপর্বা আর তাঁকে নিরুৎসাহিত করলেন না। খাট থেকে নেমে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন অ্যাটাচড্ বাথরুমের দিকে।.... 

গঙ্গার পশ্চিমপাড়ে এলো চুলে লাল টিপ পরে সন্ধ্যা এসে দাঁড়ায়, এপারে দীপেন্দু আর সুপর্বা পাশাপাশি বসে চেয়ে আছেন সেই দিকে, মাঝের নদীটা বয়ে চলেছে চেনা ছন্দে।.... সুপর্বার লম্বা আঙুলগুলো বড়ো ভালো লাগে দীপেন্দুর। সেই আঙুলের ফাঁকে আঙুল গলিয়ে হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন, -- "এই সন্ধ্যা, এই চিরপ্রবাহী নদী, ওই আগুন রঙা দিগন্তকে সাক্ষী রেখে বলছি, জীবনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমার প্রতিটা দিন এভাবেই, তোমার পাশে বসে, তোমার হাতে হাত রেখে, তোমায় ভীষণ ভালোবেসে কাটবে।.... সুপর্বা, ভালোবাসবে আমায়?"....





No comments:

Post a Comment