বিভাজন
সুকোমল কান্তি দাশ
বিক্রম কে পাড়াতে বিকি বলেই ডাকতো। কলকাতা থেকে ৪০ কিমি দূরের এক মফস্ সল শহর বারুইপুরে বেড়ে ওঠা তার। বাবা কাজ করতেন রেল ওয়েজে। মধ্যম মানের চাকরি। বিকির পড়াশুনো স্কটিশ চার্চ কলেজ, আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ।
বাবা, ঠাকুরদা'রা দেশভাগের সময় এসেছিলেন ওপার বাংলা থেকে। সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের অত্যাচারের গল্প বাবার কাছে শুনে বিকির মনে কিছুটা হলেও যে মুসলিম বিদ্বেষ আসেনি তা নয়। বিশেষত এপারে আসার পথে কিভাবে মুসলিম দুষ্কৃতিরা বড় পিসিকে ধর্ষন আর খুন করে, লুঠ হয়ে যায় সর্বস্ব; এসব শুনলেই বিকির মাড়ি শক্ত হয়ে যেতো। হাতের কব্জির শিরা ফুলে উঠতো।
বাবার কাছে যখন শুনতো বরিশালের পাতারহাটের গ্রামের জমিতে লকলকে সোনালি রুপশাল ধানের কথা। দেঊড়ির পুকুরের কালবোস মাছের কথা। তখন দেখতো বাবার চোখের কোণগুলো অনন্তের নীরবিন্দুতে ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু নির্মোহ হয়ে ঝরে পড়ছেনা। তখন বিকির অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের উদ্বাস্তু কবিতার সেই লাইনগুলো মনে পড়ে যেতো--"হিজল গাছের ফুল টুপ টুপ করে এখনো পড়ছে জলের উপর, বলছে যাবে কোথায়? একটু দুরেই কালো মেঘের মতো ধান হয়েছে, লক্ষীবিলাস ধান.."! সেই সোনার দেশ ছেড়ে পিতামহের উদ্বাস্তু হবার নিদান যারা দিয়েছিলো তাদের প্রতি বিকির চরম ঘৃণা ফুটতো টগবগ করে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন ভেসে উঠতো পার্টির লোকাল সেক্রেটারি তোফাজ্জল কাকুর মেয়ে মহসিনার কথা। ভেসে ওঠে তার মামা বাড়ির পাশে পুরানো গীর্জের পিছনে বড়দিনের সেই রাতের কথা -- একটি ১৯ বছর বয়সী ছেলে একটি ১৮ বছরের মেয়ের বুকে যখন পৌর্ণমাসির চাঁদ দেখলো তার জ্যোৎস্নায় পুড়লো, উপতক্যায় হেঁটে বেড়ালো তার কামুক অনুভূতিরা রূপোলি নদীতে ডুব দিলো তার পরমব্রহ্ম তখন বুঝেছিল যৌবন, যৌনতা ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু তসলিমা নাসরিনের লজ্জা উপন্যাসের নায়কের বাবার মতো বিকির সম্পর্ক মহসিনার সাথে গড়ায়নি।
তারপর পুলিশের চাকরি করতে এসে স্ববিরোধী দুটি স্মৃতি নিয়ে বিকির দিন কাটছিলো।
হুগলির এই থানায় ওসি হিসাবে দায়িত্ব খুব বেশিদিন সে নেয়নি। রুটিন আকারে তাকে অংশ নিতে হতো শান্তি সভায়, হিন্দু বা মুসলমানদের উৎসবের প্রাক্কালে। সেবার ছিলো কালী পূজার প্রাক্কালে শান্তি সভা। দিনটি ছিলো লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন বিকেলে। পূজাকমিটির লোকজন, নেতা, নাকড়ি, মাওলানা, ইমাম, বিডিও, বিদ্যুৎ পর্ষদের লোকজন, গন্যি মান্যিরা সব এলেন। কেউ গীতা থেকে উদ্ধৃতি দিলেন, কেউ কোরান থেকে। বিকি শান্তি রক্ষার্থে কি করনীয় তাই বললো। মিটিং শেষ হয়ে গেলো। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সবাই একে একে চলে গেলো। জয়দেবপুর এর সাত্তার মিঞা বললেন,"বড়বাবু এক কাপ চা খাওয়া যাবে?" বিকি বললো, " আসুন অফিসে আসুন!" চায়ের অর্ডার নিয়ে গেলো হোমগার্ড। সাত্তার বড়বাবুর অফিস চেম্বারে ঢুকলেন।
সাত্তার ৬০/৬২ বছরের এক ছোট্ট খাটো মানুষ। কালো রং। সাদা দাড়ি আছে। তবে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মতো নয়। পরনে সব সময়কার সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবি। কমিউনিস্ট পার্টি করেন। পেশা চাষবাস। আলুর সময় আলু ফলান,ধানের সময় ধান, বাড়তি শস্য হিসাবে সরষে উঠে আসে।
চা এলো। খেতে খেতে অনেক গল্প শুরু করলেন -- রাজ্য,রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি। চা যখন শেষ হবার মুখে, গল্প যখন জমে উঠেছে তখন সাত্তার বললেন, " যাই বড়বাবু, অনেক কাজ আছে!" বিকি জিজ্ঞেস করলো, "কি এমন কাজ?" সাত্তার বললো, " আগামীকাল লক্ষ্মীপুজো। পুজোর বাজার করতে হবে।"
বিকি বললো," আপনার আবার কিসের লক্ষ্মীপুজো?"
সাত্তার উঠতে গিয়েও চেয়ারে বসে পড়লেন। বললেন," একটা সিগারেট দিন। টানি। আর বলি কিসের পুজো!"
সিগারেট জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, " সে অনেক কাল আগের কথা। আমি তখন পেশাদার যাত্রাপালা করতাম। অম্বিকা অপেরায়। চিৎপুরে। মূলত চরিত্রাভিনয় আর যাত্রাপালায় বিবেকের ভূমিকায় থাকতো রনদেব সরকার ওরফে রানা। ভারী মিষ্টি আর উদাত্ত গলা ছিলো তার। আমার দলে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। আমাদের পাশের গ্রামেই বাড়ি।" সাত্তার দম নিয়ে আর একবার সিগারেটে টান দিলেন। বিকি বললো, "তা সেই বন্ধুর বাড়ির লক্ষ্মীপুজোর বাজার করবেন?" সাত্তার ঘাড় নাড়িয়ে বললেন, " না না বড়বাবু। হলো কি, আমি একবার ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লাম। যমে মানুষে টানাটানি। রানা একবিঘে জমি বেচে আমাকে ভেলোর নিয়ে সুস্থ করে তুললো। বন্ধুত্ব আরও নিবিড়তর হলো। ও বললো বন্ধুত্ব স্থায়ী করা দরকার। আমি তাই ভাবলাম। রানা প্রস্তাব দিলো ওর ছেলের সাথে যদি আমার মেয়ের বিয়ে দিই। প্রথমে আমার আত্মীয় স্বজন, সম্প্রদায়ের প্রবল আপত্তি ছিলো। ওরা কায়স্থ। ওদের কূলদেবতার নিত্য পুজো হয়। ওদের বাড়ি থেকেও আপত্তি ছিলো। কিন্তু আমরা দুজন মানিনি।"
বিকি একরাশ বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো সাত্তারের দিকে! ভাবলো এ ও হয়? তারপর বললো," তারপর কি হলো?"
সাত্তার বলতে থাকলেন," তারপর ছেলেমেয়েরা রাজি হলো। আমি কালো কুৎসিত হলে কি হবে আমার মেয়ে কে দেখলে আসমানের হুর মনে হবে। তারপর জেলা সদরে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হলো। পরে খাওয়া দাওয়া। অনেক নিমন্ত্রিতরাই আসেনি। পার্টির লোকজনের অনেকেই আসেনি। ভোট হারানোর ভয়ে। কিন্তু তাতে আমার বা রানার কিছুই যায় আসেনি। এখন মেয়ের ঘরে আমার দুই ফুটফুটে নাতি-- কবীর আর লালন। এরমধ্যে রানা হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে মারা গেলো দুবছর আগে। আজ মেয়ে খবর দিয়ে পাঠালো লক্ষ্মীপুজোর দশকর্মা আর প্রসাদের ফল, বাজার করে নিয়ে আসতে। তাই আজ পুজোর বাজার করে মেয়ের বাড়ি পৌঁছাতে হবে! বড়বাবু যাই।"
শুনতে শুনতে বিকি দেশভাগের গল্প, মুসলিম বিদ্বেষ, মহসীনা, সাত্তার মিঞাকে গুলিয়ে ফেললো। ভাবলো এটাই বাঙলা, এটাই ভারতবর্ষ।
দারুণ একটি লেখা।এটাই তো অনুভব
ReplyDelete