ভানুসিংহের পদাবলী যেন লৌকিক প্রেম
এক প্রাজ্ঞ রবির ছায়া ভানুসিংহতে
মধুবন চক্রবর্তী
কবি সীমার মাঝে অসীমের কথা বলেছেন বারবার। আবার অসীমও চায় সীমার মধ্যে দিয়ে আত্মচেতনা আত্ম অনুভূতির কথা বলতে। এখানেই রবীন্দ্রনাথের বৈষ্ণবতার জন্ম। জগতের আনন্দ যজ্ঞে যেখানে সবার নিমন্ত্রন সেই পঁচিশে বৈশাখ উদযাপন শুধু কবির জন্মের কথা বলে না। এই জন্মের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা সেই ভানুসিংহের বীজকে লালন করার কথাও বলে। মাত্র ষোলো বছর বয়সে ভানুসিংহ নামে তাঁর জন্ম। অর্থাৎ চেতনার জন্ম। সেই চেতনার নাম বৈষ্ণবীয় চেতনা যার প্রকাশ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী।
ভানুসিংহ ছদ্মনামে সেইসময় বৈষ্ণব পদকর্তাদের লিখে ফেলেছিলেন একের পর এক গীতিকবিতা। ১৮৮৪ সালে সেই কবিতাগুলি ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে বিভিন্ন সময় ভারতী পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। কবি বলেছেন। "অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্রের সংকলিত প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ আমি বিশেষ আগ্রহের সহিত পড়িতাম। তার মৈথিল মিশ্রিত ভাষা আমার পক্ষে দুর্বোধ্য ছিল। সেই জন্যই এত অধ্যাবস্যায়ের সঙ্গে আমি তাহার মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করিয়াছিলাম".. প্রাচীন পদকর্তাদের অনুকরণে ব্রজবুলিতে রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহের পদাবলী রচনা করেছিলেন তাই বৈষ্ণব পদাবলীর খানিকটা প্রভাব তো পাওয়াই যায় তার রচিত পদাবলীতে ভানুসিংহের পদাবলীর প্রথম পদে হল গাহানা কুসুম কুঞ্জ মাঝে এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ হলো.. সেই মেঘলা দিনের ছায়াঘন অবকাশে আনন্দে বাড়ির ভিতরে এক ঘরে খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা শ্লেট লইয়া লিখিলাম "গাহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে" (জীবনস্মৃতি)।
জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ পত্র থেকে জানা যায় নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী তাকে ভানু সিংহের কবিতাগুলি ছাপাতে অনুরোধ করেছিলেন। কবিতাগুলির মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলীর মত পালাবদ্ধ ক্রমপরিনতি ছিল না। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত ছিল এই কবিতা। কখনো বংশীধ্বনি রস পর্যায়ে আবার রস পর্যায়ের মধ্যে রাধাবিরহ বিষয়ক কবিতা মিলন বিষয়ক কবিতা ও পড়ে।
বাল্যকাল থেকে জয়দেব বিদ্যাপতি পদাবলী নান্দনিক চেতনায় মগ্ন ছিলেন। 'গীতগোবিন্দম' তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে বারবার আবৃত্তি করা সত্ত্বেও, তা অণুলিপি করেছিলেন। ভানুসিংহের পদাবলী রাধাকৃষ্ণ প্রেম বিষয়ক তথা রাধা কৃষ্ণ লীলার পটভূমিতে স্পষ্ট হলেও শুধুমাত্র রাধা কৃষ্ণ লীলার পদাবলী নয় এবং কীর্তনের শুরুতে একমাত্র বাহন নয় তার পদাবলীর মাধ্যমে ভক্তি রস ও ভগবত প্রেম ছাপিয়ে লৌকিক প্রেম জায়গা করে নিল যেখানে যেখানে সুখ দুঃখ রসিকতা স্থান পেল নির্ভুলভাবে রাধিকার মধ্যে মানবপ্রেম ও তার চির আকুলতাই আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এই পদাবলীতে।
বৈষ্ণব কবিদের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ শৈশবেই হয়ে উঠেছিলেন স্বতন্ত্র এক গীতিকবি। মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা যেমন অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তেমনি প্রভাবিত হয়েছিলেন টমাস চ্যাটারটন নামক এক ইউরোপীয় কিশোর কবির দ্বারা। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের কাছ থেকে জেনেছিলেন, টমাস চ্যাটারটন নামক এই বালক কবির কথা। যিনি প্রাচীন কবিদের অনুকরণে কবিতা লিখতেন। আর এই জায়গাতেই ভানুসিংহের সঙ্গে কবি চ্যাটরটনের অসম্ভব মিল।
পদাবলী অনুকরণে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একাধিক বৈষ্ণব কবি ও কাব্য প্রবাহের সম্মেলন ঘটেছে। যেমন উদ্ধব দাসের 'আষাঢ় গত পুণ্য মাহ শাভান সুখদ যমুনাক তীর...' এবং গোবিন্দ দাসের 'মন্দির বাহির কঠিন করাট চলোইতে শঙ্কিত পঙ্কিল বাট' রবীন্দ্রনাথ বললেন, শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথযামিনী রে...
ব্রজবুলিতে রচিত ভানুসিংহের পদাবলীর সংখ্যা রবীন্দ্রকাব্যে এবং সংগীতের অন্যতম দিকচিহ্ন। কাব্যের ধ্বনিমাধুর্যে, রস নির্মাণেও এক নতুন দিক। যেখানে বৈষ্ণবীর রাধার প্রশ্ন অপার অতৃপ্তির, ঠিক সে রকম জায়গাতেই ভানুসিংহের রাধার প্রশ্ন অজানা বিস্ময়ের। বৈষ্ণব পদাবলীর স্বভাবকে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন একান্তভাবে।
কিশোর বয়সের রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ভানু সিংহের পদাবলী কিশোর রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করলেন এই পদাবলী যেখানে তার চিন্তার মৌলিকতা যেরকম রক্ষা পেল পাশাপাশি বয়স্ক প্রাজ্ঞ আরও এক রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট ছাপ প্রকাশ পেল। যেমন মরণ ঋতুহু মম শ্যামো সমান এই পথটিতে ভানুসিংহের কিশোরত্ব লোভ পেয়েছিল যেখানে জন্ম নিয়েছিল ভানু সিংহ ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার অভিন্ন রূপ। মৃত্যু মহা জীবনের রূপান্তর মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই জীবনের প্রকাশ কিশোর বয়সেই সেই মহানুভবতার কথা তিনি প্রকাশ করেছিলেন যা আমাদের এক প্রাপ্য রবীন্দ্রনাথকেই চিনতে সাহায্য করে তার চিন্তায় জীবন মৃত্যু চলমান সৃষ্টির নিরন্তর আবর্তন। মৃত্যুর যে সুন্দর রূপ ভানু সিংহের চিন্তায় প্রকাশ পেয়েছে যেখানে নেই মৃত্যুর ভয়াবহতার কথা দুশ্চিন্তার কথা মৃত্যুর সুন্দর মোহন রূপ ভানু সিংহের চিন্তায় যেন নব ঘন স্বামীর সুন্দর মূর্তি। এই বলা যেতেই পারে, ভানুসিংহ পদাবলী শুধু বাংলার ঐকান্তিক সম্পদ নয়,।আন্তর্জাতিক সাহিত্যের ইতিহাস এক আধ্যাত্মিক ঐশ্বরিক প্রেম বিষয়ক সাহিত্যের নব দিগন্তের সূচনা করে। তার পদের ভাব ও গভীরতা প্রাচীন পদকর্তাদের রচনা থেকে কোন অংশেই কম ছিল না। পথগুলির মধ্যে ছিল স্বকীয়তা, স্বতন্ত্রতা প্রত্যেকটি পদ যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ভাবের গভীরতায়, ব্যঞ্জনার মাধুর্যে, ব্যঞ্জনার মাধুর্যে ভাস্বর। পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয় তার রসের বিশিষ্টতায় শেষ ভাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত।
No comments:
Post a Comment