হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
পাখি রঙের আকাশ ----- ৯৮
যতক্ষণ না তুমি নিজে বলছ ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার বাড়ি মোটামুটি একটা চেহারা নিয়ে বড় দোকানতলার মোড়ে টালি মাথায় দাঁড়িয়ে থাকবে। পায়ে চলা পথ নদীর ধার ঘেঁষে বটগাছের ভেতর দিয়ে কিছুটা থমকে আবার হাঁটা শুরু করবে। ধর্মঘট জেনেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছবে। কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে যেই তুমি বারবার পিছনে তাকাবে, সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে তোমায় চেপে ধরবে বড় দোকানতলার মোড়, পায়ে চলা পথ, ধর্মঘট। হাতের তালুর দিকে তাকাও ------ ওটাই তোমার জীবন। একটা রেখা কি ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে আসছে দ্যাখো। লাল ফিতে প্রায় ছোঁবে ছোঁবে এমন সময় কে যেন ছুটে এসে কি একটা নিয়ে পালালো। কোনো কথা নেই। এ যেন শিকড়ে শিকড়ে বিপ্লবের আগুন। পাশের রেখাটি কত শান্তভাবে পথ হাঁটে ; মনেই হবে না একটু আগে কী ভীষণ দৌড়ঝাঁপ হয়েছে।
রাজশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
মোরগফুল
একদিন ঘর ছেড়ে ছিলাম ৷ পুরানো ঘাট ,নাটমন্দির , আম সুপারির বাগান সব ছেড়ে এসেছি ৷ শুধু ছাড়তে পারিনি সেইসব স্মৃতি , যেখানে তুই মশগুল হয়ে আছিস ৷ যেখানে বৃষ্টির ফোঁটায় স্বপ্নদের বসতবাড়ি ৷ হাজার বছরের পুরানো শিব মন্দিরের গা বেয়ে নেমে গেছে অজস্র শেকড় ৷ যে শেকড় খোঁজ রাখে আমিদের প্রতিটি দিনযাপনের কথা ৷ যে মেঘ দূত হয়ে আসত , যে মোরগফুল আমাদের যাতায়াতের পথে ফুটে থাকত , তারা জানে ,গাছের গায়ে ঢিল বেঁধে আমরা যে অঙ্গীকার করেছিলাম , তা আর রাখা হয়নি ৷ তুই ছেড়ে গেছিস ৷ বৃষ্টি শুকিয়ে গেছে ৷ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের দায় তোকে কোতোয়ালে দিতে পারিনি ৷ কারণ তোর দেওয়া কথাগুলো , কোনদিনই মুদ্রণ হয়নি ৷ আমি ঘুমের ভেতর নড়ে উঠি ,তুই পাশে শুয়ে শতাব্দীর নিদ্রায় ৷
জাতিস্মরের গল্প
আত্মলোপ অঙ্গীকারে জীবনের গ্রাস মুখে তুলিনি ৷ মৃত্যুর প্রতি নৈকট্য অনুভব করি বারবার ৷ গর্ভিণী ইচ্ছেগুলোর শ্বাসরোধ করে পৃথিবীর সাত ভাগ জলের নিবিড় গর্ভগৃহে পুঁতে এসেছি কবেই ৷ প্রেমের আর্দ্রতা কুমুদিনী করে না আমাকে ৷ জ্বলন্ত অঙ্গার মারিয়ে অনন্তের পথে হেঁটে যাই ৷ ক্লান্তিহীন জঙ্গম জীবন নিয়ে অনায়সে বারোয়ারি নলকূপে ধুঁয়ে নিই ভালোবাসার স্ফটিক স্বাদ ৷ রক্তের ফোঁটা ফোঁটা বুদ্বুদে সন্ধ্যা নামে ৷ আমি যন্ত্রণার মরিচগুলো ডলে নিই জন্মান্তরের আলপথে ৷ প্রতিটি জন্মে উদবাস্তু আগুনকে বুকে জড়িয়ে খান্ডব দহনে মাতি ৷ প্রেমের কুসুমভার জ্যোতির্ময় করে না আমায় ৷ পাঁজরের ফাঁকে-ফাঁকে , জ্বলতে থাকা তুষের আগুন, জাতিস্মরের গল্প শোনায় ৷
পোশাকী মিথ্যেরা
বিস্তৃত উঠোন জুড়ে পোশাকী মিথ্যেরা বকেদের ডানার গোধূলির রং নিয়ে বাসা বাঁধে অশরীরী অসহিষ্ণুতায় ৷ চটে যাওয়া রং, ওপরানো শিকড়, নদী বক্ষে জমেছে পলি ৷ অঘোর আলস্যে চেতনার শবদেহ নিয়ে শুয়ে থাকি ৷ প্রতিটি বুদবুদ কালো রক্তের ফোঁটা ৷ গনগনে পৃথিবীর প্রকোষ্ঠে অবারিত বিচ্ছেদ, অসূয়া জমছে ৷ দূরে যেতে যেতে নিষ্প্রভ সম্পর্ক-বিতানে, কূজন কাকলি শূণ্য ঘাট ৷ কাছিটার বা্ঁধন আলগা হয়েছে ৷ ডুব সাঁতারে হেনেছে আঘাত ৷ উন্মুক্ত ক্ষত চিহ্ন ধীরে ধীরে বড় হয় ৷ বিষাদ স্মৃতির রেশ টুকু নিয়ে উদভ্রান্ত-বিলাসে পৃথিবীর কক্ষপথে আজও ভ্রাম্যমাণ আমি ৷ উদবাস্তুর মত নিজের অস্তিত্বকে কাটা ছেড়া করি ৷
দূরে তথন তোমার রাজপ্রাসাদে আরও একটা সর্বনাশ লেখা হচ্ছে ৷
অবৈধ
বৈধ অবৈধের শৃঙ্খলে আমাকে আবদ্ধ কোরো না ৷ যা কিছু অবৈধ তাকে নিঙরে নিই ৷ চুমুকে পান করি তোমার অনাবৃত বিস্ময় ৷ উড়ুক্কু মাছের মত রঙ বেরঙের আলোর নেশা আমাকে নষ্ট করেছে বারবার ৷ যতবার দেহজ খনিজ তুলে নিয়েছে কেউ ততবার আমি আরও আরও ঐশ্বর্যবতী হয়েছি ৷ বৈধতার ভার আমার সহ্য হয় না ৷ কবেই আলগা করেছি সে দায় ৷ একে একে আঁশ ছাড়িয়ে নরম মজ্জা সাজিয়ে রাখি রেকাবিতে ৷ উন্মুক্ত নয়ানজুলি, ঝুল বারান্দায় শালিকের দল খুঁটে খায় রাতের শস্য ৷ তোমার পুরুষ্টু ঠোঁট দুটোয় লেগে থাকা রমণবিলাসী ক্বাথ আমার দম্ভ ৷ তুমি তো মধুকর আমি গরবিনী অঙ্গনা ৷
ভিক্ষার পাত্র ভরে দিয়ে মদমত্ত উল্লাসে প্রতিনিয়ত সৃষ্টিকে ছুঁড়ে দিই স্পর্ধা
No comments:
Post a Comment