শম্পা ব্যানার্জি
একটা লকডাউন রাতের গল্প
আজ ক'দিন ধরে আমার মন ভালো নেই। কেন নেই জানিনা। আমার সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেও ভালো লাগলো না। তাই গতকাল থেকে সরে গিয়েছিলাম।
আজ এক বন্ধুকে বল্লাম, "আমার আর কিছুই ভালো লাগছে না। মাঝে মাঝে এই রাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার ঘরে এসে বলতে ইচ্ছা করে, কেউ জেগে আছো?"
পরক্ষণেই ভাবি এসবের দরকার কোথায়? সবুজ আলো জ্বলছে তো! উনিভার্সিটির দিনে ট্রেনের দরজা থেকে একটু ঝুঁকে মুন্ডি বার করে দিয়ে সিগন্যালের আলো সবুজ দেখলেই, হৈ হৈ ব্যাপার। এইবার ট্রেন ছাড়বে। কল্যাণী পৌঁছব। নেমেই দৌড়বো। শাড়ি পরলেও আঁচল গাছ কোমর করে দে দৌড়। বাসের লাইনে, একে বা প্রথম দশে দাঁড়িয়ে আহা সে যে কী আনন্দ। আমার প্রিয় বাস "মাই ফেয়ার লেডি।" ওর জানলার পাশের আসনে যে না বসেছে, সে কেমন করে জানবে। আর বাস ছাড়লেই গোঁ গোঁ আওয়াজ, জানলায় পুরো কাঁচটা সরিয়ে দিলে, বাইরে গলে যাওয়ার ভয়। সে এক থ্রিলিং! আরও একটা বাস ছিলো তার নাম মুড়ির টিন। মুড়ি যেমন টিনে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ভরে তারপর, মুখটা চেপে আটকে দেওয়া হয়। এটাও ছিলো তাই। চাপতে চাপতে শেষজনকে চেপে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হতো। আর বাসটা বাঁ দিকে কাত হয়ে চলতে শুরু করতো। আসলে, বাঁ দিকেই তো দু'টো দরজা। শেষের দিকের মুড়ির ভারটা ও দিকেই পড়েছে।
তবে, উনিভার্সিটি তে স্কুলের মতো, দৌড়ে গিয়ে প্রথম বেঞ্চিতে বসার তাড়া ছিলো না। I was always backbencher..পেছনে না বসলে গল্প করা যাবে না। খুনসুটি হবে না। হাসাহাসি হবে না। আচ্ছা, এসব কথা বলতে বলতে আমার মনখারাপিয়ার চোখ দুটো চলে গেলো হঠাৎ বাইরের অন্ধকারের দিকে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। মুখোশ বেঁধে সোজা নীচে। ওয়াচম্যান বিজয়কে বল্লাম, গেটটা খুলে দে। ও বলছিলো না। লকডাউন। পুলিশ বিরক্ত করবে। নিঝুম রাস্তা, আকাশে আধখানা চাঁদ আর ল্যাম্পপোস্টের আলোয়, মায়াবি রাত দেখে মনে হচ্ছে, কে বলবে, এই পৃথিবীর বুকে এখন করোনার গ্রাস। একটা পিৎজা ডেলিভারি বয়ের সাথে কিছু কথা হোলো। ও এখন করোনাকে পরোয়া করে না।পেটের জ্বালার থেকে করোনা বড় নয়। দূর থেকে, এলেন এক বাহাদুর। আমাদের সোসাইটির ঠান্ডা জলের মেশিন থেকে জল নিয়ে যান। সাথে একটা সাদা স্ট্রীট সারমেয়। খুব ভাব নাকি দু'জনের। সিং জী আমাকে দেখে মাস্ক খুলে গল্প করতে লেগে গেলেন। গাজীপুরে বাড়ি। সেখানকার হালচাল বলতে লেগে গেলেন। বল্লাম, করোনার গল্প আর শুনতে চাই না। আপনি আসুন। সারমেয় সমেত রাস্তা পার হয়ে চলে গেলেন।
সিকিউরিটি বিজয়ের কী হাসি। বিজয় আর আমার মাস্ক একই। আমি সবাইকে কিনে দিয়েছি ডিজাইনার মাস্ক। একটা কথা ভেবে পাইনা, কেউ একটু চুপ থাকতে দেয়না। সবাই কি তাহলে হাঁপিয়ে উঠেছে? আমি এসেছি নিঝুম রাতের নিঝুমতা কিনতে। পরশু সন্ধ্যেবেলায় ধূমকেতু দেখেছি। কিন্তু, ছবি তুলতে পারিনি। খুব জ্বল জ্বল করছিলো নিউইজ। আজ আধখানা চাঁদ আর দেখলাম লালচে তারা। ওটা মঙ্গল গ্রহ। এটা চিনতে অসুবিধা হয় না। আমার কাছে একটা বুশনেলের বাইনোকুলার আছে, যা দিয়ে দূরে কিছু দেখতে গেলেই আমার চশমা পরা চোখে ব্যালেন্স না হয়ে অন্যলোকের ঘরের ভেতর দেখা যায়। তাই আর দেখি না। তবে, একবার দূরে পার্কে মাঝরাতে ওই বাইনোকুলার দিয়ে একটা আস্ত বিয়ে দেখেছিলাম। মালাবদল থেকে সিঁদুর দান। নর্থের বিয়ে খুব অল্প সময়েই শেষ হয়ে যায়। তারপর, দেখলাম তরতাজা নতুন বউটিকে বর বাবাজীবন কী যেন বলছেন। মেয়েটি আনত চোখে এক মুখ লজ্জার হাসি হাসছে। আসলে বাড়ির লোকজন ওদের স্টেজে বসিয়ে খেতে দৌড়িয়েছে। আমার বর তখন আমেরিকায়। কথা বলার জন্য রাত জাগতে হোত। তাই ব্যালকনিতে অমন জীবন্ত সিনেমা দেখার সুযোগ হয়েছিলো। আর হ্যাঁ, বর আর কনে নীল অর্কিডের মালা পড়েছিলো। কী ভালো লাগছিলো মেয়েটাকে। এখন আর পার্কটা দেখতে পাইনা। কী এক ক্লাউড নাইন এসে ওর গগনচুম্বী ইমারত দিয়ে আমার প্রিয় পার্ক থেকে আধখানা আকাশ সব ঢেকে দিলো।
এসব ভাবতে ভাবতে বিজয় আর মাহিন্দর দু'জনেই বল্ল চা খাবে। তা, আমি চা বানিয়ে ওদের দিলাম। আমি খেলাম। ওরাও খেলো। সাথে পার্লে জি বিস্কুট। শুনেছি জীবনের বহু অবস্থা অতিক্রম করলে বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হয়। আবার"বোধিসত্ত্ব"শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে, বুদ্ধত্ব। আর অবলোকিতেশ্বর হলেন বোধিসত্ত্বগণের অন্যতম। জীবনের অনেক পথ হেঁটে এসেছি। এমন ভয়াবহ সুন্দরী তিলোত্তমা রাতে তোমায় প্রশ্ন করি, " নতুন ভোরের আর কত দেরি হে অবলোকিতেশ্বর ?
মেঘপিয়ন।
No comments:
Post a Comment