Sunday 25 September 2022

মুখোমুখি || তাপস দাস

 

    আলাপচারিতায় ভাস্কর এবং চিত্রশিল্পী তাপস দাসের সাথে কবি এবং অধ্যক্ষা 
   রাকা মুখোপাধ্যায়
                                              

ভাস্কর শিল্পী তাপস দাস, জন্ম মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে (১৯ ডিসেম্বর ১৯৬৫)। অধুনা পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরের আদি বাসিন্দা। বর্তমানে কলকাতাতেও থাকেন। পিতা স্বর্গীয় সুনীল দাস, মাতা ছায়ারাণী দেবী। শিক্ষাগত যোগ্যতা, স্নাতক। স্বশিক্ষিত ভাস্কর।

তাপস দাসের খ্যাতি মূলত ভাস্কর্যের জন্য, দেশ পেরিয়ে বিদেশেও। মূলত তামা পিতল লোহারধাতব সিট থেকে ওয়েল্ডিং করে বানান তার মৌলিক ভাস্কর্য। সঙ্গে তিনি ছবিও আঁকেন। পেন পেনসিল চারকোল জলরঙ আক্রেলিকে।

যাপনে বোহেমিয়ান। তাঁর জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে সোনাঝুড়ির বনে, খোয়াইয়ের পাড়ে, ভুবনডাঙার মাঠে, কখনও বা অজানা নদীর ধারে। কণ্ঠে নিয়েছেন রবীন্দ্রগান। শান্তিনিকেতনের বিশিষ্ট গায়িকা স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র ছিলেন একসময়। তাঁর জীবনের অনুভূতির সংলাপ কখনও ফুটে উঠেছে ছবিতে, কখনও প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখার ছন্দে।

মল্ল সাহিত্য শারদীয়া পত্রিকার পক্ষ থেকে গল্পে, আড্ডায় পাঠকের সাথে ভাগ করে নিলাম তাঁর শিল্প-কথা, তাঁর যাপন-কথা।

রাকা: সুস্বাগতম! মল্ল সাহিত্য শারদীয়া পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন।

তাপস: আনন্দম্। মল্ল সাহিত্য পত্রিকাকেও আমার অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

রাকা: বহরমপুরে জন্ম, কাটোয়ায় বড় হওয়া তারপর শান্তিনিকেতনে শিল্পী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখতে শিখতে যখন একজন সঙ্গীত শিল্পী হবার স্বপ্ন দেখছিলেন, তখন কিভাবে হঠাৎ ভাস্কর শিল্পী হবার দিকে আপনার প্রবণতা তৈরী হল সে গল্প যদি কিছু বলেন।

তাপস: বিষয়টা হচ্ছে যে ভাস্কর শিল্পী হবার কোন স্বপ্ন আমার ছিল না। ছোটবেলায় সবাই যেমন মাটি নিয়ে খেলা করে, রং নিয়ে খেলা করে, আমারও সেভাবেই বেড়ে ওঠা। মাটির মূর্তি বানাতাম ছোট ছোট যেমন হয়, তার বেশি কিছু নয়। আমার নিজের কাছেও খুব অবাক লাগে কীভাবে আমি ভাস্কর্যের কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেললাম, নিজের কাছেই খুব বিস্ময় লাগে কারণ শান্তিনিকেতনে আমি গিয়েছিলাম শিল্পী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের কাছে গান শিখতে, সেখানেই আমার তালিম শুরু এবং দীর্ঘ দিন গান শেখা। আসলে যেটা হয়েছিল, আমার বাড়ি কাটোয়ায়, আর কাটোয়া থেকে শান্তিনিকেতন যাবার একটাই বাস ছিল সকালবেলা। সেই বাসে করে যেতাম, দশটা নাগাদ পৌঁছতাম, তারপর এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা মত ক্লাস হত, তারপর ফিরতি বাস ছিল আবার বিকেল চারটেয়। তাই জন্য অনেকখানিটা সময় আমাকে শান্তিনিকেতনের ভিতরেই কাটাতে হত। সেই কারণেই, কী করব? গানের ক্লাসের পরে তো আমার আর কোন কাজ নেই। তাই সেখান থেকে চলে আসতাম, কলাভবনের চত্বরে এদিক ওদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতাম। বিভিন্ন জন কাজ করছে সেগুলো দেখতাম, সঙ্গে শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন জায়গায় রামকিঙ্কর বেজের যে সমস্ত বড় বড় স্কাল্পচার রয়েছে, সোমনাথ হোরের কাজ রয়েছে, সেগুলো দেখতাম। কিন্তু আমি নিজে এই ধরনের কাজ শুরু করব, সেই ভাবনা আমার মনে কখনও জাগেনি। হঠাৎই একদিন এক বন্ধু আমাকে কাজ করার প্রস্তাব দেয় যে একটা স্মারক বানিয়ে দিতে হবে, একজনকে দেবে। তখন আমার মনে হয়েছিল, মেটালের সাথে কাঠ মিশিয়ে একটা কাজ করেছিলাম। সেই প্রথম আমার ভাস্কর্যের হাতে খড়ি বলা যেতে পারে।

রাকা: এই মেটাল দিয়ে ভাস্কর্য তৈরি, সেটা তো ব্রোঞ্জ ইত্যাদি দিয়ে যেভাবে স্কাল্পচার তৈরি হয়, তার থেকে তো আলাদা! আপনি কিভাবে ধাতব ভাস্কর্য তৈরি করেন সে কথা একটু বলুন।

তাপস: আমি আসলে সিট মেটাল বা ধাতব পাত নিয়ে কাজ করি। অনেকেই মেটালের কাজ করেন, তাঁদের নিজস্ব বিভিন্ন রকমের টেকনিক আছে, পদ্ধতি আছে যেভাবে তাঁরা কাজ করেন। কিন্তু আমার কাজের ক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে, আমাকে শীট মেটালকে জুড়ে, ব্লেণ্ড করে,ওয়েল্ডিং করে সেটাকে একটা ফর্মে আনতে হয় এবং এটা সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের পদ্ধতি, যে পদ্ধতিতে আমি পৃথিবীর কথা বলতে পারব না, ভারতবর্ষের কাউকে আমি এই পদ্ধতিতে কাজ করতে দেখিনি। আর এই কাজের মৌলিকত্ব হচ্ছে যে, আমার মাথার মধ্যে যে ছবিটা আছে, তাকে টোটালি প্রথম থেকে সেভাবেই তৈরি করতে হয় কারণ যদি একটু কোথাও ভুল হয়ে যায় তাহলে গোটা মূর্তিটাই আমাকে ফেলে দিতে হবে, কিচ্ছু করার থাকে না তখন।

রাকা: আচ্ছা এই যে ধাতব পাত জুড়ে ভাস্কর্য বানানোর আইডিয়াটা কিভাবে আপনার মাথায় এল?

তাপস: এটা কাজ করতে করতে হয়েছে। মানে প্রথম দিকে তো আমি বাড়িতে পুজোর থালা, বাসন ঐ সমস্ত গুলোকে কেটে বানাতাম। তখন তো এই ধরনের মেটাল যে কোথায় পাওয়া যায়, তাও জানতাম না। তারপর ঐসব কেটেকুটে কাজ করতে করতে খবর পেলাম কোথায় মেটাল পাওয়া যায়, তারপর সেখান থেকে সেটা আনা ইত্যাদি। এখন যেটা খুবই সহজ আমার কাছে তখন সেটা বেশ কঠিন ছিল। মেটাল জোগাড় করা, তার খরচ সামলানো, একটা বিশাল টাকার ব্যাপার ছিল। আর্থিক দিক থেকেও ব্যাপারটা বেশ কঠিন ছিল।

রাকা: সেই সময় আপনার যে পথ চলা শুরু, আর আজকে আপনি একজন বিশিষ্ট ভাস্কর… এই দুই সময়ের ব্যবধানে আপনার নিজের কাজকেই যদি তুলনামূলক বিচার করতে বলা হয়, আপনি কি বলবেন?

তাপস: আগে যে সমস্ত কাজ করেছি আর এখন যে কাজ করছি দুটোর মধ্যে হেল অ্যান্ড হেভেন ডিফারেন্স। কারণ আমি নিজেও বুঝতে পারি আগের কাজের সাথে এখনকার কাজের গুণগত
পার্থক্যটা। কাজের প্রতি যে যত্ন সেটা হচ্ছে আসল। যে কাজটা আমি করছি, সেটা কতখানি যত্ন নিয়ে আমি করছি, তার উপর নির্ভর করে কাজটা কতটা ভাল হবে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভাবনা এবং দিনে দিনে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে সেখান থেকে ক্রমশ উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে গেছে আমার কাজ। দেশে বিদেশে অনেকেই সংগ্রহ করছেন আমার কাজ।

রাকা: এই যে আপনার নতুন নতুন ভাবনা, নতুন নতুন সৃষ্টির রূপ পাচ্ছে, এর অন্তরালে কি বিশেষ কারোর প্রভাব বা অনুপ্রেরণা আছে?

তাপস: অবশ্যই আছে। রামকিঙ্কর বেজ এবং সোমনাথ হোর, এঁদের দুজনের কাজই বলা যেতে পারে আমার কাজের জন্য প্রেরণা জুগিয়েছে। আমি প্রথম যখন দেখি সোমনাথ হোরের কাজ, ওই অদ্ভুত ধরনের বিমূর্ত রূপ দিচ্ছেন মেটাল জুড়ে জুড়ে, আরেক দিকে রামকিঙ্করের কাজ, এত গতি তাঁর কাজের মধ্যে, ভীষণ ভাবে আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। আসলে আমার যেটা হয়েছে, আমি মেটাল ব্যবহার করেছি, কিন্তু সোমনাথ হোরের যে বিমূর্ত ভাবনা, সেটা থেকে বেরিয়ে রামকিঙ্করের যে ভাবনা, যে ধরন, তার প্রতি আমার ঝোঁকটা বেশি। আর এই মহান দুই শিল্পীর কাজ আমাকে ভীষণ ভাবে মুগ্ধ করেছিল বলেই আজ আমি এই জায়গায়
আছি।

রাকা: কোথাও কি সোমনাথ হোরের সৃষ্টি এবং রামকিঙ্কর বেজের সৃষ্টি আপনার সৃষ্টির সাথে মিলে মিশে যাচ্ছে?

তাপস: বলা যেতে পারে। আসলে দুজনের দুটো ঘরানা। রামকিঙ্করের ঘরানা আলাদা, কাজের স্টাইল আলাদা, সোমনাথ হোরের কাজের স্টাইল আলাদা। রামকিঙ্কর কাজ করতেন মূলত নুড়ি সুড়কি এ সমস্ত দিয়ে, আর সোমনাথ হোরের কাজ ছিল মূলত মেটাল ওয়ার্ক। দুর্ভিক্ষের সময়ের যে ছবিগুলো তাঁর আছে, সেই পেনের আঁচড়ের কাজগুলো দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়, ভীষণ স্ট্রং তাঁর হাতের রেখা। অপর দিকে রামকিঙ্করের কাজের যে বলিষ্ঠতা, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমি এঁদের দুজনের কাজের যে ধরণ সেই দুটো ধরনের মধ্যে একটা মেলবন্ধন আনার চেষ্টা করেছি।

রাকা: ভাস্কর্যের পাশাপাশি আপনি পেন্টিংও করেন, কিন্তু আপনার বেশি ভাললাগা কোনটাতে?

তাপস: দেখুন এটা সম্পূর্ণ একটা অভ্যাসের ব্যাপার। যাঁরা নিয়মিত পেন্টিং করেন তাঁদের কাছে সেটা একটা সহজাত বিষয়, তাঁদের রঙের ব্যবহার থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু, তাঁদেরও নিজস্ব কিছু স্টাইল থাকে। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও আমি যে স্টাইলে কাজ করি সেটা একদমই একটা অন্যরকম চিন্তা ভাবনা থেকে। এখন বিষয়টা হচ্ছে যেহেতু আমার ভাস্কর্যের চাহিদা বেশি, কাজের চাপও বেশি, পেন্টিং আমার খুব বেশি করা হয়ে ওঠে না। তবে করি না তা নয়, আমিও সময় পেলে ছবি আঁকি, মাঝে মধ্যে বিভিন্ন প্রচ্ছদের পেন্টিং করি, সবই করি, কিন্তু যেহেতু ভাস্কর্যের কাজটা নিয়মিত আমাকে করতেই হয়, সেটা প্রায় বাধ্যতামূলক এখন আমার কাছে। সারাদিনের একটা নির্দিষ্ট সময় আমাকে ভাস্কর্যকেই দিতে হয়, আমি পেন্টিংকে দিতে পারি না। তার ফলে পেন্টিং-এর জায়গাটা মাঝে মাঝে হয়তো দুর্বল হয়ে পড়ে, আবার কিছুদিন নিয়মিত সেই কাজটা করতে পারি যখন, সেটাও একটা উৎকর্ষের জায়গায় পৌঁছোয়, অনেকেই সেই ছবি সংগ্রহ করেন।

রাকা: আপনার ভাস্কর্য এবং ছবি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও পাড়ি দিয়েছে। সেই গল্প কিছু শুনলে ভাল লাগবে।

তাপস: সে এক অদ্ভুত গল্প। আসলে আমি তো কখনও ভাবিনি যে আমার কাজ কেউ কিনবে, কেউ সংগ্রহ করবে। এরকম ধরনের ভাবনা আমার মাথাতেই আসেনি। অনেক দিন আগে আমি একবার পাহাড়ে গেছিলাম এবং সেখানে বসে ছবি আঁকছিলাম।তখন হঠাৎই একটি কমবয়সী ছেলে এবং তার স্ত্রী সেখানে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার ছবি আঁকা দেখছিল। তাদের সাথে আলাপ হয়, কথাবার্তা হয়, সন্ধ্যায় আড্ডাও বসে, তারা নিমন্ত্রণ করে, সেখানেও যাই। তারাই আমাকে প্রস্তাব দেয়, “আপনি যে কাজগুলো করেন, সেগুলো নিয়ে শান্তিনিকেতনের মেলায় আসুন। আমি একটা স্টল নিচ্ছি, সেই স্টলে আপনার কাজ আমি রাখব।” সেই প্রথম আমি শান্তিনিকেতনের মেলায় যাই এবং সেই মেলাই পৃথিবীর কাছে আমার দরজা খুলে দেয়। এরপর থেকে প্রতি বছরই আমি শান্তিনিকেতনের মেলায় আমার কাজ নিয়ে যেতাম এবং মূলত তার জন্যই কাজ করতাম।সেখান থেকেই মানুষ জন আমার কাজ সংগ্রহ করত। সেই সূত্রেই প্রচুর মানুষ জনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। শান্তিনিকেতনে প্রচুর বিদেশিরা আসেন, তাঁরা ঘুরে ঘুরে কাজ দেখেন। সেভাবেই নানা দেশের মানুষ আমার কাজ কিনেছেন, সে হাঙ্গেরী হোক, সিঙ্গাপুর হোক, আমেরিকা, জার্মান, ফ্রান্স, বাংলাদেশ অনেক দেশেই আমার কাজ গেছে এবং সেই মানুষ জনেরা এখনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। তাঁরা অনেকে আমার বাড়িতেও এসেছেন আমার কাজ দেখার জন্য। এটা আমার কাছে একটা বড় প্রাপ্তি।

রাকা: আজকে একজন ভাস্কর হিসেবে আপনার নাম যে লাইমলাইটে এসেছে, তার পিছনে কি কোনভাবে কারোর অবদান আছে? যদি থাকে তো তাঁদের কথা কিছু বলুন।

তাপস: সেটা বলতে গেলে বলতে হয়, শান্তিনিকেতনে আমি দ্বিতীয়বার যখন যাই, সেবারেই আমার সঙ্গে আলাপ হয় অরুণ মুখোপাধ্যায় নামে বীরভূমের আনন্দবাজার পত্রিকার যিনি মূল সাংবাদিক ছিলেন, তাঁর সাথে। ভদ্রলোক নিজে লেখালেখি করেন,  ছবি আঁকেন, ওনার কোলাজের কাজ ভীষণ ভাল। উনি আমার সাথে গল্প করতে করতে আমার সম্পর্কে জেনেছিলেন এবং আমি অবাক হয়েছিলাম তার পর দিনই আমাকে নিয়ে একটা লেখা তিনি আনন্দবাজারে লিখেছিলেন। আমি জানতামও না, আমার সম্পর্কে ডিটেল জেনে তিনি যে আনন্দবাজারে ছাপবেন, সে আমার ধারণাও ছিল না। সেই প্রথম আমার কাজ নিয়ে আনন্দবাজারে যে লেখা বেরিয়েছিল, সেটা অনেকটাই আমার এগিয়ে যাবার রাস্তা তৈরি করে দেয়। তারপরেও বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। হঠাৎই একদিন মেলাতে এক ভদ্রমহিলা এসে বললেন, “আমার এক বন্ধু আছে, উনি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান। ওনাকে আমি আপনার কাজের ছবি পাঠাচ্ছি, উনি আপনার সাথে যোগাযোগ করবেন।” তিনি তখন সিঙ্গাপুরে ছিলেন, তার পরদিন তিনি সিঙ্গাপুর থেকে শান্তিনিকেতনের মাঠে এসে আমার সাথে যোগাযোগ করেন এবং আমার বাড়িতেও আসেন, তাঁর নাম শ্রীমতী অবন দেশাই। অবন দেশাই আমাকে নিয়ে প্রথম কাজ করেন, একক। আমার কাজের একক প্রদর্শনী হয় তেজাস আর্ট গ্যালারিতে। সেটাই আমার প্রথম সোলো এক্সিবিশন। এরপর অনেক বিখ্যাত মানুষের, অনেক গুণীজনের সংস্পর্শে এসেছি, তাঁদের অনেকেই এখন নেই, যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণ ঘোষ, হাসান আজিজুল হক বাংলাদেশের, চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ, পরবর্তী কালে চিত্রশিল্পী সমীর সরকার, অমিত ভর, সুকান্ত দাস, প্রসেনজিৎ সেনগুপ্ত এবং আরও অনেক মানুষের কাছাকাছি এসেছি, অনেকে আমার কাজ সংগ্রহে রেখেছেন, এটা আমার কাছে বড় পাওয়া। আসলে ওভাবে তো বলা মুশকিল, প্রতিটা ঘটনার একটা পরিপ্রেক্ষিত থাকে এবং সেই সময়ের জন্য সেই ঘটনা কতটা প্রভাব ফেলছে সেটাই বিষয়। আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে একটি নাম, সদ্য প্রয়াত রঞ্জন ঘোষাল।মহীমের ঘোড়াগুলির যে সাতটা ঘোড়া ছিল, তার একটা ঘোড়া ছিলেন রঞ্জন ঘোষাল। হঠাৎই আমার কাছে একটা ফোন আসে, “তাপস আমি তোমার কাটোয়ার বাড়িতে আসছি,” আমার কাছে সেটা একটা আশ্চর্য ঘটনা।তিনি এবং তাঁর স্ত্রী এসেছিলেন ব্যাঙ্গালোর থেকে আমার বাড়িতে এবং এক রাত্রি আমার বাড়িতে ছিলেন। সেই সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে একটা আসর বসেছিল এবং সেই রাত্রে তিনি গান গেয়েছিলেন, “মহারাজ এ কী সাজে এলে হৃদয় পুরমাঝে”, সে যে কী অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। মাথায় একটা সেই সুণ্ডীর রাজার মত পাগড়ি লাগিয়েছিলেন, আর চুলের একদিকটা সাদা, একদিকটা সবুজ…অসাধারণ। ওঁর কাছেই আমি শিখেছিলাম কীভাবে গানে নাটকীয়তা আনতে হয়।

রাকা: আপনি বললেন যে আপনি শিখেছিলেন কীভাবে গানে নাটকীয়তা আনতে হয়। যাঁরা আপনার গান শুনেছেন, সে ঘরোয়া বৈঠকেই হোক বা অনুষ্ঠানেই হোক, তাঁদের কাছে আপনার গান একটা বার্তা নিয়ে আসে। কথার সঙ্গে ভাবের অনুরণন যেভাবে আপনি উপস্থাপন করেন, সেখানে কি এই নাটকীয়তার একটা ভূমিকা আছে?

তাপস: আসলে অন্য কিছু নয়, সাধারণ ভাবে সকলে যেভাবে গান করেন, তার থেকে আমি একটু ছকের বাইরে গাইতে চেষ্টা করি। আমার মনে হয় প্রথমে গানটা বোঝা উচিত, গানের মধ্যে দিয়ে কবি কি বলতে চাইছেন। গানের যে লিরিক, সেটা দুবার পড়ে নিলে আমার মতে সবচেয়ে ভাল হয়। যেমন একটি গান যেটা ভীষণ ভাবে জনপ্রিয়, গানটা আশা ভোঁসলে তাঁর মত করে গেয়েছিলেন, “স্বপ্নে আমার মনে হল কখন ঘা দিলে আমার দ্বারে”। কিন্তু স্বস্তিকাদি শিখিয়েছিলেন গানটা ভাব দিয়ে গাইতে। এর পরে রঞ্জন ঘোষালের কাছে আমি জেনেছিলাম কীভাবে গানের মধ্যে নাটকীয়তা আনতে হয়।

রাকা: শান্তিনিকেতন আর রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে আরেকটি নাম বিশেষভাবে উঠে আসে, তিনি বিক্রম সিং খাঙ্গুরা, তাঁর সাথে আপনার গভীর বন্ধুত্ব ছিল আমরা শুনেছি। তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই। তাঁর সাথে কাটানো কিছু সময়কে যদি আমাদের সঙ্গে একটু ভাগ করে নেন।

তাপস: শান্তিনিকেতনে যখন গান শিখতে যেতাম তখন বিভিন্ন মানুষের সাথে আলাপ হয়েছিল, তাঁদের কেউ ছিলেন কবি, কেউ গায়ক…এরকম আর কি। সেরকমই এক বন্ধুর মারফত বিক্রম সিং এর সাথে আমার আলাপ হয়। বিক্রম কেন জানিনা আমাকে খুব পছন্দ করত। আমি রবিবার যখনইগান শেখার জন্য যেতাম শান্তিনিকেতনে, কলাভবনের চত্বরে ঘুরে বেড়াতাম, ওর একটা বাইক ছিল, সেই বাইকটা নিয়ে চলে আসত। তারপর আমাকে খুঁজে বার করত, তখন তো আর এরকম সেল ফোন ছিল না। আমি কোথায় থাকতাম ও জানত, তো ওখানে এসে আমাকে বাইকের পিছনে বসিয়ে নিয়ে যেত বিভিন্ন জায়গায়। ওর সঙ্গে ঘুরতাম। আমি ওর বিভিন্ন সময়ের সাক্ষী হয়েছি, চেতনে অচেতনে ওর গান শুনেছি… সে এক অন্য অনুভূতি। তার সেই উদাত্ত কণ্ঠে গানের সেই উচ্চারণ… একজন অবাঙালি হয়েও কত সাবলীল তার উচ্চারণ, যে উচ্চারণ হয়ত আমারও পরিস্কার নয়, তবু তার কণ্ঠে গানের কথার কত পরিষ্কার উচ্চারণ করছে সে, ভাবা যায় না। আমাকে মাঝে মাঝে আটকে দিত শান্তিনিকেতনে, বলত “তুই থাক আজকে, যেতে হবে না তোকে।” আমার সমস্যা হত, তখন তো সেল ফোন নেই, আমার বাড়িতে জানাতে পারছি না, আমার বাড়িতেও কোন ফোন নেই। আমার পরিবার খুবই গরীব ছিল। তো যে কোন ভাবেই হোক, সে আমার তখন একটা পলিটিক্যাল জগত ছিল, তাদের মাধ্যমে খবর পাঠিয়ে হয়ত সেই রাতটা থেকে গেলাম। এভাবেই আমার বোহেমিয়ান জীবনের অনেকখানিটা সময় আমি তার সাথে কাটিয়েছি। তার গান, তার বোহেমিয়ান জীবন আমাকে ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট করত।

রাকা: এই বোহেমিয়ান জীবনের ছবি আপনি আপনার কথামালার মধ্যে দিয়েও এঁকে চলেন, সেখানে সোনাঝুড়ির আধো-ছায়া জ্যোৎস্নায় এক ছায়ামানবীর খোঁজ অহর্নিশ জেগে থাকে। সেই খোঁজ কি আপনার চিরন্তন?

তাপস: কঠিন প্রশ্ন। প্রত্যেকটা মানুষের খোঁজ থাকে এবং সে খোঁজ অন্তহীন। তাকে কোন ভাবেই কোন ফর্মুলায় ফেলা যায় না। আমি যতটুকু নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি, প্রতিটা মানুষের একটা নিজস্ব বেড়ে ওঠা থাকে, তার খোঁজও তার নিজের পথ ধরে চলে।

রাকা: দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর এঁকেছেন আপনি আপনার কথামালার মধ্য দিয়ে, যাকে আপনার খেয়ালের প্রলাপ গাথা নাম দিয়েছেন। সেই কথামালার সংকলন, আপনার প্রথম বই ‘নোঙর বাঁধি চাঁদের কিনারে’ প্রকাশিত হয়েছে ‘দক্ষিণের বারান্দা’ থেকে এই বছরের বইমেলায়। এই বই নিয়ে কিছু যদি বলেন।

তাপস: এই বইটির প্রকাশ আমার কাছে একটি অভাবনীয় ঘটনা। আমার কিছু বন্ধু মিলে আমার প্রলাপের বকবকানি গুলো নিয়ে বই ছাপাতে চেয়েছিল, ওরাই করেছে সব। ওই লেখাগুলো যে কোনদিন ছাপা হতে পারে সে আমার কল্পনার বাইরে ছিল। তারা বলেছিল আমাকে কিছু ছবি এঁকে দিতে ওই বইটার জন্য। আমি আমার মত করে ছবি এঁকে দিয়ে দিয়েছি। তারপর সেগুলোকে পরপর গুছিয়ে ম্যানুস্ক্রিপ্ট করা, দক্ষিণের বারান্দার পাবলিসার্সের মাধ্যমে তাকে প্রকাশ করা…সবটাই তারা করেছে। দক্ষিণের বারান্দার সম্পাদক শ্যামলবরণ সাহা নিজে একজন শিল্পী হওয়ার কারণে ছবি ও লেখার যে যুগলবন্দী, সেটা একটা উচ্চতর মান পেয়েছে এই বইয়ে। যাঁরাই এই বই হাতে নিয়েছেন, সকলেই প্রভুত প্রশংসা করেছেন। বইটির প্রচ্ছদ চিত্রও আমার আঁকা। বইটির মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, লেখক কিন্নর রায়, কবি তন্ময় চক্রবর্তী, কবি মন্দিরা ঘোষ, চিত্রশিল্পী সুকান্ত দাস এবং কবি সূর্য মণ্ডল। বইটির বেশ কিছু রিভিউ এসেছে, তাঁরা ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আমার লেখা এবং ছবির, তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অনেকেই আমার লেখাগুলোকে নিয়ে আবৃত্তি করছেন, রেকর্ড করছেন, অনেক বেশি আনন্দ পেয়েছি তার জন্য। তাঁদেরকেও আমার অশেষ ধন্যবাদ জানাই।

রাকা:“ভালোবাসা হলে ভোরের আকাশে কৃষ্ণচূড়া ফোটে। চাঁদ তখনও লেগে থাকে আকাশের গায়ে,চেয়ে থাকে অপলক নিদ্রাহীন চোখে। ভালোবাসা হলে জ্যোৎস্নায় হাসনুহানা ফোটে, অকারণ সুবাস বিলায়…তেপান্তর জুড়ে। ”আপনার এই যে প্রলাপ গাথা, তাকে কি আপনার যাপনের সাথে আপনার ভাবনার রং মিশিয়ে রচনা করেছেন? সে বিষয়ে যদি কিছু বলেন।

তাপস: আসলে যে লেখাগুলো আমি লিখেছি, তার প্রায় আশি ভাগ অচেতনে লেখা এবং তার পিছনে আমার সেই মুহূর্তের যাপন কাজ করেছে, কোনভাবেই সেটাকে আমি অস্বীকার করতে পারব না। যে কারণে এই লেখাগুলোকে আমি ‘প্রলাপ’ বলেছি।


রাকা: আপনার এখনকার লেখাগুলো অন্যরকম, ছন্দবদ্ধ লেখা, যথেষ্ট সমাদৃত হতে দেখেছি ফেসবুকে। তাহলে একজন ভাস্কর শিল্পী, চিত্র শিল্পী, সঙ্গীত শিল্পীর পাশাপাশি আমরা কি আপনাকে একজন প্রতিষ্ঠিত কবি হিসেবেও আশা করতে পারি ভবিষ্যতে?

তাপস: না না, এমন কোন আমার ইচ্ছে নেই, এমন কোন ভাবনাও আমি পোষণ করি না। মাঝে মধ্যে ছন্দ আসে মাথার মধ্যে, তখন লিখি। এমন নয় যে প্রতিদিন আমি নিয়ম করে লিখছি বা আমাকে লিখতেই হবে, তা নয়। আমি দেখেছি জোর করে লিখতে বসলে আমার লেখা আসে না।

রাকা: আজকে আপনি একজন বিশিষ্ট ভাস্কর। আজ থেকে পাঁচ বছর বাদে আপনি কোথায় পৌঁছনোর স্বপ্ন দেখেন?

তাপস: এই নিয়ে আমার কোন স্বপ্ন নেই কারণ আমি কখনও ভাবিই নি যে আমি একজন ভাস্কর হিসেবে নাম করব।এই যে আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন, এও আমার স্বপ্নের বাইরে। আমি জানি আমার হাতে কিছুই নেই। আমি শুধু আপন খেয়ালে নিজের কাজ করে যাই, সে ভাস্কর্য বলুন, ছবি বলুন, কবিতা বলুন…আমি শুধু চেষ্টা করে যাই।


রাকা: 

“আকুল ঠোঁটে ইচ্ছে করেই ভুলকে রাখি,
ইচ্ছে করেই গড়তে থাকি ভুলভুলাইয়া-
অল্প জীবন, হাতের মুঠোয় নেই জোনাকি ,
নেশার ঘোরে প্রহর মেপে জ্যোৎস্না ছোঁয়া।”

আপনার মূল্যবান সময় এবং আপনার যাপনের গল্প সকল পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেবার জন্য আপনাকে মল্ল সাহিত্য পত্রিকার পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। খুব ভাল থাকবেন। শুভ শারদীয়া!


তাপস: মল্ল সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীকে এবং সকল পাঠকবৃন্দকে আমার শারদীয়ার শুভেচ্ছা জানাই। ভাল থাকবেন সকলে, ভাল থাকবেন আপনিও।


2 comments:

  1. অসংখ্য ধন্যবাদ মল্ল সাহিত্য ই পত্রিকা এবং রাকা মুখোপাধ্যায় কে

    ReplyDelete
  2. দেবলীনা26 September 2022 at 15:51

    ভীষণ ভালো লাগলো এই অপূর্ব আলাপচারিতা 🌹🌹

    ReplyDelete