Saturday 23 January 2021

জানুয়ারি সংখ্যা≈ গল্প ✪ প্রদীপ দে

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ||  প্রদীপ দে    

ইচ্ছামৃত্যু

বিলম্বিত ঘুমভাংগা শীতের সকাল, ভোরের নাগাল পাওয়া বড়ই দুষ্কর! কলোরব নিদ্রিতদের জাগিয়ে তোলে। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ সরকারি আবাসনের মধ্যে এক ফ্ল্যাটে। রবিবার হওয়ায় আমেজ ছিল বেশি, ঘাটতি হল সুখের। সকালেই উঠে ঝামেলার কারণ বোঝার আগেই সকলেই দেখল, শান্তি বাবুকে পুলিশ ধরে ফেলেছে। দৌড়ে গিয়ে দেখা গেল রুনুদির শরীর সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে, যা আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হতে পারে আত্মহত্যা, তা কিন্ত নয়, অনেকেই খোলা জানালা দিয়ে দেখে ফেলেছে শান্তি বাবুই রুনুদির পায়ের তলার টুলটি সরিয় নিচ্ছে। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকায় অনেকেই ভিতরে ঢুকতে পারেনি, পুলিশকে খবর দেয় এবং চটজলদি পুলিশও এসে যায়। বডি নামানো হলে অল্প প্রানের ধুকধকানি পাওয়ায় হসপিটালে পাঠানো হয়েছে। 
অন্য দিকে শান্তিবাবু স্বীকার করে নেয় সেই তার স্ত্রী কে হত্যা করতে চেয়েছিল। সকলেও অবাক হয়ে যায় নিরীহ গোবেচারার এহেন স্বীকারোক্তিতে!

লকআপ থেকে জেল। বিচার শুরু হয়েছে। এজলাসে হাজির ছিলেন অনেক উৎসাহী প্রতিবেশী।

আবাসনের এক তরুন আইনের ছাত্র সমুদ্র , যদিও বা বেকার তবুও ধনীপুত্র, এই ব্যাপারে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে। ডিপার্টমেন্ট ওই তরুনটিকে পাত্তা দেয় না। তরুনটি নিজ চেষ্টায় কৌতূহল নিরাসনে নিজ উদ্যোগে মাঠে নেমে পড়ে এবং প্রভাবশালী কিছু লোকের সাহায্য নেয়, ধনী ঘরে যেটা সহজলভ্য!
সমুদ্র। শান্তি বাবুর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়। সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার করে। যদি ও শান্তি বাবুকে তার বেশ বড় খেলোয়াড় বলে মনে হয়।

-- আপনি কেন কিছু বলছেন না?

-- খুনী কি বলবে?

-- আপনি সুযোগ। নিচ্ছেন।

-- খুনী বাঁচার সুযোগ নেয় শুনেছি। 

-- আপনি আসল কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন।

-- তুমি। মানে তোমাকে ছোট ভেবে তুমি বলছি। কিছু মনে করো না, আসল কোন কথার কথা বলতে চাইছো?

-- আপনার স্ত্রী অসুস্থ ছিলেন। বহুদিন এক জটিল রোগের শিকার হয়েছিলেন।

-- তাতে কি আসে যায়?

-- উনি মরতে চেয়েছিলেন। উনি ওনার যন্ত্রনা আর সহ্য করতে পারছিলেন না। আপনি ওনার অসহায় অবস্থা আর যন্ত্রনা সহ্য করতে পারছিলেন না। ---তাই ---?

-- থামুন থামুন খুব হয়েছে। আপনি কি লেখক নাকি গোয়েন্দা?

-- না আমি একজন আইনের ছাত্র মাত্র। আপনার প্রতিবেশী এবং আপনার থেকে অনেক ছোট বয়সে। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। সত্যি কথা বলতে কি আমি এই অধ্যায়টা আইনের সাহায্যে অনুকূলে , মানে আপনার ফেভারে আনতে চাই।

-- কিন্ত আমি তা চাই না। আমিতো কোর্টকে জানিয়ে দিয়েছি আমি উকিল নেবো না। আর আমি একজন খুনী ।সেক্ষেত্রে ফাঁসি হলে সবচেয়ে ভালো হয়।

-- আপিনি কিন্তু জানেন না এসব কেসে ফাঁসি হয়না। যাবজ্জীবন হতে পারে,কিন্তু আপনার যা বয়স মানে সিনিয়র সিটিজেন হিসাবে আপনার ব্যাপারে কোর্ট অনেক কিছুই ভাবতে পারে। সেক্ষেত্রেও আপনার ইচ্ছাপূরণ হবে না।

-- কি বলতে চাইছো তুমি?

-- আমি কিছুটা বুঝতে পেরেছি। আপনি নিজেকে সরাতে চাইছেন এই জগৎ থেকে।

-- তাহলে আমি অন্যকে কেন মারবো? নিজেকেই তো মারতে পারতুম?

-- তাহলে আপনার স্ত্রীর কি গতি হতো? ওর যন্ত্রনার কি হতো?

-- বয়সী শান্তিদেব নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে।সময় হয়ে গেছে এজলাসে যাওয়ার। সেদিকেই পা বাড়ায় রক্ষীদের আমন্ত্রণে।

সমুদ্র হতাশ নয়নে চেয়ে থাকে। চেষ্টার শেষ দেখতে চায়।

সমুদ্র বিষয়টাকে নিয়ে  বিশেষ মনোযোগ দেয়।কেন জানিনা তার মনে হয় এটা কোর্টে ভুল বিচার হয়ে যাবে। নিজে উদ্যোগে অনেক জনের সংগে কথা বলে। প্রতিবেশী  থেকে ডাক্তার এবং পেশাদার উকিলকে সব জানায়। সকলের পরামর্শ মতো শান্তি বাবুর স্ত্রীর ডাক্তারের কাছে যায়। অনেক তথ্যের ভিত্তিতে একটি খসড়া রচনা করে।তারপর ছোঁটে উকিলের কাছে। নিজের বিনিয়োগে উকিল দাঁড় করাতে চায়। উকিল সমস্ত কাগজপত্র দেখে সম্মতি জানায়। বুঝে ফেলে এ কেস তাদের ফেভারেই যাবে। 

এরপর আসল লড়াই শুরু হয় কোর্টে। এমনিতেই। সিনিয়র সিটিজেন হওয়ায় অনেক সুবিধা জোনে ছিল শান্তি বাবু। কিন্তু প্রমান নথিতে অবাক হয়ে যায় সকলেই। বেকসুর খালাস হয়ে যন শান্তি বাবু।
নির্দোষ প্রমাণ হয়ে যান। সকলেই অবাক হয়ে যায়।
কারণ অনেকে তাকে সেদিন আততায়ী হিসাবেই হাতেনাতে ধরেছিল, যদিও বয়স্ক ছিলেন তাই একটু মমত্ববোধ কাজ করেছিল তদাপি কাকিমাকে সবাই ভালোবাসতো তাই এই খুনের খুনীকে মাপ করতে পারেনি - সবাই চেয়েছিল উন শাস্তি পান।

মানুষ চাইলেই তো আর হয় না। বিশেষত আইনের ক্ষেত্রে সমস্ত ব্যাপারটাই বেশ জটিল। বাইরে থে ঘটিনা বোঝা বড় দুস্কর! তাই হল। শান্তি  বাবু ছাড়া পেয়ে গেল। এটি  আত্মহত্যাই। তাহলে যে শান্তিবাবুর কার্যকলাপ - যা অনেকেই দেখে ফেলেছে,  সেটার কি হবে?

রহস্য উন্মোচিত হল - তরুন সমুদ্র -র তথ্যবহুল ব্যাখায় যা কোর্ট মেনে নিল।

প্রতিপাদ্য বিষয় হলঃ

সন্তানহারা ছিলেন এই দম্পতিরা। আবাসনের সকলের কাকা কাকিমা - শান্তিবাবু আর রুনুদি। বহু রোগের শিকার ছিলেন বার্ধক্যজনিত কারণে উভয়ই। তবে রুনুনেবী হঠাৎই অবসাদজনিত কারণে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলেন। সারা শরীরে তার প্রভাব পড়েছিল। অসহ্য শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনায় ভুগছিলেন তিনি। যে যন্ত্রনা শেষে চোখে দেখা যেত না। প্রথম প্রথম ডাক্তার আর হসপিটালের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল কিন্তু তেমন কিছু লাভ হয়নি। সামান্য পরীক্ষায় তেমন কিছু ধরা পড়েনি। বেশী দূর এগোতে পারেন নি অর্থাভাবে।

ওদের এক ছেলে বিজয়। বেসরকারি চাকুরে ভালো আয় করতো। প্রেম করে বিয়ে। ধনী ঘরের মেয়ে জয়ী, বিয়ের পর থেকেই বাপের বাড়ি ছিল যার প্রথম পছন্দ। পুত্র সন্তান হলো। কিন্তু  সংসারে মন না পসন্দ - বাহির মুখো। অশান্তি শুরু যার শেষ হয় জয়ীর বিবাহের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং পাওয়া পুত্রকে নিয়ে বাপের কাছে ফিরে যাওয়া। বিজয়ের ভালোবাসাহীন জীবন মদে আসক্ত হয়ে যায়।
ব্যাপকভাবে নিজেকে ধংসের হাতে ঠেলে দেয়।
বছর দুয়েকের মধ্যে সেরোসিস অফ লিভার এর কবলে পড়ে। একদিন আচম্বিতে মৃত্যুর হাতে নিজেকে সমর্পণ করে।

বাবা শান্তি কষ্ট হলেও সামলে নেয়। মা রুনু পাগল হয়ে যায়। বিছানা নেয়। রোগেরা ভিড় জমায় তার শরীরে। 
অসহায় শান্তি বাবু স্ত্রী রুনু কে নিয়ে আরো বিপদে পড়ে।

ডাক্তার, চিকিৎসা অনেক করা হয়। রুনু দিনের দিন শর্য্যাশায়ী হয়ে পড়ে।চিকিৎসায় সাড়া দেওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। ডাক্তার নিয়ম মাফিক কাজ করে গেল। অঢেল টাকা গলে গেল। অর্থাভাবে সংসার অচল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল।

শান্তি বাবু অধৈর্য হয়ে পড়লো। রুনুর সঙ্গে বিবাদ শুরু হলে, রুনু মৃত্যু চাইলো। মরণ চাইলেই কি পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে সে নিয়ম চালু হয়নি। ইচ্ছা মৃত্যু যে একেকটা জীবনে কতটা প্রয়োজন এ কথাটা এদের মত লোকেরাই বোঝে।

শান্তি অসহায়, রেগে গেলেও বউকে ভালোবাসে। তাই ঠান্ডা মাথায় নিজেরাই একটা বিষয়ে দুজনেই একমত হল। দুজনায় আত্মহত্যা করবে। প্রথমে স্ত্রী করবে আর স্ত্রী যখন শর্যাশায়ী তখন স্বামীই তাকে সাহায্য করবে। তারপর স্বামী ও সেই পথেই যাবে।
আর সেই সাহায্য টুকু করতে গিয়েই ধরা পড়ে যায় শান্তি বাবু। হিতে বিপরীত হয়ে যায়। নিজের আর আত্মহত্যা করা হয় না। সব জানাজানি হয়ে স্ত্রীও হসপিটালে চলে যায়। স্ত্রী মরে যাবে এই আশংকায় শান্তিবাবু ফাঁসি মুখো হতে চায়।
 
একদিন সমস্ত ঘটনা বিশদে বুঝিয়ে দেয় সমুদ্র। আইনের ছাত্র হয়ে অজান্তেই কখন যেন গল্পকার হয়ে ওঠে সে। সব্বাই মন দিয়ে সব শোনে আর আফসোস করে ভুল ভেবে, তারা বোকার মত ভুল বুঝেছিল। সবাই একমত হয় রুনু কাকিমা হসপিটাল থেকে ফিরে এলে ওদের দুজনার দেখা - শোনার দায়িত্ব তারাই নেবে।

আর সমুদ্র আবাসনের হিরো হয়ে যায়!

No comments:

Post a Comment