মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা , ২-য় বর্ষ , ২৩-তম প্রয়াস
মানুষ বিবেকানন্দ রাজদীপ ভট্টাচার্য
নরেন্দ্রনাথ দত্ত ওরফে স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ, দার্শনিকতা, জীবে প্রেম ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা আমরা বলি। কিন্তু এসবের পিছনে সেই মানুষটির মানবিক দিকগুলি চাপা পড়ে থাকে। কেমন ছিলেন মানুষ বিবেকানন্দ? বিভিন্ন বইপত্র, তথ্য প্রভৃতি থেকে যা জানা যায় তা নিম্নরূপ।
উচ্চতা - ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি, গাত্রবর্ণ - না ফরসা না কালো। অনেকে একে উজ্জ্বল অলিভও বলেছেন। ওজন বয়সের সাথে সাথে কম বেশি হয়েছে। রোমাঁ রোলাঁ ৭৭ কেজি এমনটা ইঙ্গিত করেছেন। আবার অন্যত্র সময়ান্তরে ১০২ কেজি অব্ধি ওজনের কথাও অনেকে বলেছেন। উল্লেখ্য স্বামীজী নিজেকে মজা করে "মোটকা সন্ন্যাসী" বলতেন। তাঁর মাথার চুল ঘন কালো এবং তা যেন ঢেউ খেলানো বাবরি চুলের অরণ্য। আবার শেষের দিকে তাঁর চুল দ্রুত পাকতে শুরু করেছিল, যা তিনি দুঃখ করে চিঠিতেও লিখেছেন। যৌবনে দেহসৌষ্ঠব অসাধারণ। দীর্ঘ নাসা। হাড় চওড়া। বিস্তৃত বক্ষ। পেশিবহুল বাহু। চওড়া কপাল। কঠিন চোয়াল। হাতের পাতার সৌন্দর্য তুলনাহীন। চাঁপার কলির মতো আঙুল। নখ অর্ধচন্দ্রাকার এবং রক্তবর্ণ। পায়ের পাতা পাতলা, সরু ও লম্বাটে। বিবেকানন্দের চোখ ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণীয়। ভাবানুযায়ী কখনো দৃপ্ত, কখনো তন্ময়, কখনো আবার অগ্নিবর্ষী। নিন্দুকেরাও তাই বলেছিলেন যে ওনার আঁখিপদ্মের আকর্ষণেই বিদেশী মহিলারা পতঙ্গের মতো ছুটে আসে। তাঁর কন্ঠস্বর ছিলো ব্যারিটোন। বিস্তৃত জনসমাগমেও তাঁর স্বর অনায়াসে সবার কাছে পৌঁছাত। তিনি হাঁটার সময় খুব দ্রুত বা ধীরে চলতেন না। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বপূর্ণ ভঙ্গিতে এগোতেন। বক্তৃতা দেওয়ার সময় কখনো কখনো দুই হাত ধীরে ধীরে প্রসারিত করে দিতেন দুপাশে।
"ন তস্য রোগো ন জরা ন মৃত্যু;
প্রাপ্তস্য যোগাগ্নিময়ং শরীরম্"
উপনিষদের এই শ্লোকে যদিও বলা হয়েছে যে, যোগাগ্নিময় দেহ পেলে আর রোগ, জরা, মৃত্যু কিছুই থাকে না। এমন সিংহহৃদয় যোগী মানুষটির শরীর কেমন ছিলো? সংসারজীবনে থাকাকালীন তিনি আদর যত্নে ভালোই ছিলেন। কিন্তু তাঁর সন্ন্যাসজীবন বারবার তাঁর দিকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
প্রায় ৩১ রকম রোগ স্বামী বিবেকানন্দকে বারংবার কষ্ট দিয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মধুমেহ বা ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ডিমেনশিয়া বা নিদ্রাহীনতা এবং পেটের সমস্যা। এদের মধ্যে প্রথম দুটি ওনার বংশগত রোগ। বাবা বিশ্বনাথ দত্তও মূলত এই দুই রোগে ভুগে মাত্র ৫১ বছর বয়সে মারা যান। কলম্বোতে ডাক্তাররা স্বামীজীর ডায়াবেটিস রোগটি চিহ্নিত করেন। সেই সময় ইনসুলিন আবিষ্কার হয়নি। বাকী জীবন এই রোগটি তাঁকে তীব্র সমস্যায় ফেলেছে বারবার। জীবনে তিনবার তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয় বলে মনে করা হয়ে থাকে। প্রথমবার লন্ডনে, দ্বিতীয়বার মিশরে এবং শেষবার বেলুড়মঠে যা তাঁকে না ফেরার দেশে নিয়ে চলে যায়। তিনি বারবার বলেছেন যে তাঁর মনে পড়ে না শেষ কবে তিনি চারঘন্টা ঘুমিয়েছেন। বারংবার তিনি চিঠিতে বিভিন্নজনকে লিখেছেন একটু ঘুমের জন্য তাঁর আকুলতার কথা। আর পেটের বহুবিধ সমস্যা যেমন বদহজম, পেট খারাপ, উদরী, লিভারসমস্যা ইদ্যাদি প্রায় তাঁর নিত্য সঙ্গী ছিলো।
তাহলে বিবেকানন্দের মতো যুগপুরুষও কি এই জাগতিক রোগযন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি? না, পারেননি। তবে এতে তাঁর মাহাত্ম্য কিছু কমে না। বরং এখানেই তাঁর কৃতিত্ব যে তিনি মাত্র ৩৯ বছরের আয়ুষ্কালে এই রোগজর্জর শরীর নিয়েই এই বিশ্বকে শাসন করেছেন। পথ দেখিয়েছেন। শুধু একজন দার্শনিক বা ধর্মীয় গুরু হিসেবেই নন, একজন মানবহিতৈষী দক্ষ সংগঠক রূপেও তিনি জন্মের দেড়শতাধিক বছর পরে তাই আজও প্রণম্য, এক চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।
তাহলে বিবেকানন্দের মতো যুগপুরুষও কি এই জাগতিক রোগযন্ত্রণার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি? না, পারেননি। তবে এতে তাঁর মাহাত্ম্য কিছু কমে না। বরং এখানেই তাঁর কৃতিত্ব যে তিনি মাত্র ৩৯ বছরের আয়ুষ্কালে এই রোগজর্জর শরীর নিয়েই এই বিশ্বকে শাসন করেছেন। পথ দেখিয়েছেন। শুধু একজন দার্শনিক বা ধর্মীয় গুরু হিসেবেই নন, একজন মানবহিতৈষী দক্ষ সংগঠক রূপেও তিনি জন্মের দেড়শতাধিক বছর পরে তাই আজও প্রণম্য, এক চিরস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।
No comments:
Post a Comment