Wednesday, 22 January 2020

মৌসুমী রায়

মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা , ২-য় বর্ষ , ২২-তম প্রয়াস












অচিনপুর-৪       মৌসুমী রায় 

সকালে মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে জিয়ার। আহ! কতদিন পর যে এমন সুখের ঘুম ঘুমিয়েছে সে ভুলেই গেছে। পোশাক বদলে সাদা চুড়িদার পরে সাথে সাতরঙা ওড়না। বাইরে এসে দেখে রাধামাধবের আরতি শুরু হয়ে গেছে। তিমির সাদা পাঞ্জাবি আর জিন্সে, খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। পুজোর শেষে সবাই ঠাকুরের পায়ে আবীর দেয়,গুরুজনদের পায়ে আবীর দিয়ে রঙ খেলা শুরু হয়। জিয়া অবাক হয়ে দেখে তার বেরঙিন মাকে কি সুন্দর লাগছে গোলাপি হলুদ রঙে। বাবা চলে যাওয়ার পর মার জীবন থেকে সব রঙ বাদ হয়ে গেছিলো। আত্মীয়রা মানা করেছিলো তাই, মা রঙিন শাড়িও পরেনি কখনো। তিমিরের পিসিমা তিমির সবাই মিলে মাকে নানা রঙে  রাঙিয়ে দেয়। সে বুঝতে পারে মাও বেশ খুশি এখানে এসে একদিনেই জায়গাটা মার খুব প্রিয় হয়ে গেছে। এরপর গ্রামে ঘুরে ঘুরে দুজন রঙ খেলে, যখন তিমির প্রথম জিয়ার গালে রঙ লাগায় জিয়ার বুকের ভিতর ভালো লাগার ঢেউ খেলে যায়। এরপর প্রচুর হইচই করে সময় কেটে যায়।মাঝ দুপুরে ফিরে এসে স্নান খাওয়া সারে।  জিয়া একটা হলুদ রঙের শাড়ি পরে যেটা মাসিমা তাকে উপহার দেয় দোল উপলক্ষে। জিয়ার মা জিয়াকে দেখে খুব খুশি হন, মেয়ে যে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে।  তিমির আর জিয়া আবার আসে নদীর পারে, আজ অনেকটাই জলের কাছে এসে বসে দুজন। চুপচাপ নদীর বয়ে যাওয়া দেখে। তিমির জিয়ার উড়ে যাওয়া চুল হাত দিয়ে ঠিক করে দেয়, বেশ লাগে জিয়ার। জিয়া বলে ' জানো আমার একটা ফ্রান্স থেকে আমন্ত্রণ পত্র এসেছে ছবির ওয়ার্কশপের জন্য। হয়ত দুমাস থাকতে হবে আমায়।' তিমির খুব খুশির সাথে বলে ' আরে বাহ এত ভালো খবর এতক্ষণ বলনি।  দারুণ জিয়া দারুণ, তুমি অনেক নাম কর আমি গর্বিত হব নিজেকে তোমার বন্ধু ভেবে।' জিয়ার ভালো লাগে কথাটা শুনে।  
 ফিরে আসে দুজনে বাড়িতে, কাল ফিরে যেতে হবে জিয়াদের।  ওরা এসে দেখে মা মাসিমা আর তিমিরের মা তিনজনে উপরের ঘরে গল্প করছে। তিমির সবার জন্য চা করে নিয়ে আসে আরো কিছুক্ষণ গল্প করে। জিয়ার মা তিমির কে বলে 'বাবা আমি কিন্তু মাঝে মাঝে এসে থাকব এখানে, তোমার কোন আপত্তি নেই তো?' তিমির হা হা করে হেসে ওঠে বলে 'কি যে বল মাসিমনি তুমি এখানেই থেকে যাও মা আর পিসিমার সাথে।' জিয়ার মার খুব ভালো লাগে তিমিরের কথা, এত বড় বাড়ির ছেলে অথচ কি সাধারণ ভাবে থাকে। উনি আজ জেনেছেন রোজ দুবেলা অনেক অভুক্ত মানুষ এবাড়িতে পেট ভরে  খাওয়ার খায়। আর এই নিয়ম তিমিরে প্রপিতামহের আমল থেকেই হয়ে আসছে। এরপর আরতির সময় হয় সবাই নিচে আসে। আজকের আরতি অন্যান্য দিনের চেয়ে একদম আলাদা। জিয়া যেন স্বপ্নের মধ্যে আছে। আরতির শেষে গান হয় ছোট ছোট বাচ্চারা নাচ আবৃত্তি করে। তিমির সবাইকে পেন পেন্সিল খাতা উপহার দেয়। এমনো হয়! জিয়া যত দেখছে যত জানছে তিমিরকে ততই অবাক হচ্ছে। ধীরে রাত নামে, মন ভারি হয় কাল ফিরতে হবে। রাতে ছাদে যায় জিয়া আর তিমির। তিমির সিগারেট ধরিয়ে জিয়াকে জিজ্ঞাসা করে আজ যে সে মাসিমনিকে রঙ লাগিয়েছে তাতে কি জিয়া কিছু মনে করেছে?  জিয়া বলে ' এমা না না আমি খুব খুশি হয়েছি, তোমাদের এখানকার মানুষ অনেক উদার আমাদের সো কলড শহুরে মানুষদের থেকে। মাকে আজ ভারি সুন্দর লাগছিলো। আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ তিমির। এমন সুন্দর সময় উপহার দেওয়ার জন্য।' তিমির তার একটা হাত জিয়ার মাথায় রেখে বলে চিন্তা করনা ম্যাডাম, আমার উপহার আমি চেয়ে নেব ঠিক।  তখন দেখব দাও কিনা,এবার চল কাল সকালে বেরোতে হবে। জিয়া এগোলে তিমির জিয়ার হাত টেনে বলে 'আবার কবে আসবে জিয়া?' 
 জিয়া হেসে নিচে নেমে আসে, যে যার ঘরে চলে যায়। পরেরদিন সকালে সবার কাছে বিদায় নিয়ে তারা স্টেশনের দিকে রওনা দেয়, তিমিরও যায় ওদের ট্রেনে তুলতে। ট্রেন আসলে সে জিয়ার হাতে একটা চিরকুট দেয় আর বলে আমি উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম। সময় নিয়ে ভেবে উত্তর দিও। ট্রেন ছেড়ে দেয়, যতক্ষণ জিয়া তিমিরকে দেখতে পায় ততক্ষণ সে দেখে তিমির একদৃষ্টে জিয়ার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। বেশ অনেকটা পথ পেরিয়ে জিয়া চিরকুট টা খোলে। তাতে লেখা ' জিয়া আমি অনেক কিছু বলতে চেয়েও পারলাম না, শুধু এটুকু বলি তুমি কি আমার জিয়া হয়ে সারাজীবনের মত এখানে এসে থাকবে। না তাড়া নেই ভেবে জানিও আমি অপেক্ষায় থাকব আজীবন। আমার গ্রামে শহুরে চাকচিক্য নেই, কিন্তু সততা আর ভালো মানুষ অনেক আছে। ভালোবাসা নিও। 
জিয়ার চোখে জল টলটল করছে, একি সবই রাধামাধবের ইচ্ছে? তাই কি সেদিন জিয়া অচেনা স্টেশনে নেমেছিলো? কি উত্তর দেবে তিমিরকে সে যে মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। তাও তিমিরকে তার.... 

ক্রমশ...

No comments:

Post a Comment