মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা , ২-য় বর্ষ , ২৩-তম প্রয়াস
অচিনপুর-৫ মৌসুমী রায়
অচিনপুর-৫ মৌসুমী রায়
জিয়ার যাওয়ার দিন এগিয়ে আসছে যত, ততই তার ব্যস্ততা বাড়ছে। এরমধ্যে অনেকবার তিমিরের সাথে কথা হয়েছে তার,কিন্তু তিমির একবারো আর চিঠির প্রসঙ্গ তোলেনি। জিয়াকে কোন অস্বস্তির মধ্যে ফেলেনি,শুধু বলেছে জিয়ার ফ্রান্সে যাওয়ার আগে সে একবার কলকাতায় আসবে দেখা করতে। দেখতে দেখতে দিন এসে গেলো, তিমির এসে হাজির কলকাতায়। এয়ারপোর্টে জিয়ার মা এবং তিমির দুজনেই যায় জিয়াকে ছাড়তে। জিয়া আড়চোখে যতবার তিমিরের দিকে তাকিয়েছে ততবারই দেখেছে তিমিরের চোখ উত্তর চাইছে। জিয়া উত্তর দিতে পারেনা কোনো, প্লেনের সময় হয়ে যায় জিয়া চলে যায়। তিমির মাসিমনিকে নিয়ে ফিরে আসে, ওনাকে বাড়িতে নামিয়ে রাতের খাওয়ার খেয়ে হোটেলে ফিরে যায়। আসার সময় আকাশের দিকে চেয়ে চোখ দুটো জলে ভরে গেছিলো, সে আশা করেছিলো জিয়া কিছু বলে যাবে। নাহ কিছু বলেনি জিয়া। পরেরদিন সে ফিরে যাবে, মনে মনে ভাবে সত্যি তো একটা শহুরে মেয়ে কি করে ওই গ্রামে গিয়ে থাকবে। সে হয়ত একটু বেশি ভেবে ফেলেছে জিয়াকে নিয়ে, কিন্তু জিয়াকে ভুলে থাকা যে অসম্ভব তার পক্ষে।
জিয়া প্লেনে ওঠার পর থেকেই তিমিরকে বার বার মনে করতে থাকে, এটা সে ঠিক করেনি তারও তো তিমিরকে ভালো লাগে। একবার তো বলতেই পারত যে অপেক্ষা কর আমি ফিরে আসব তোমার কাছে। আমারো তোমার সুন্দর মনে আশ্রয় চাই তিমির। একটা মানুষ ভুল বা খারাপ বলে তো সবাই খারাপ হতে পারেনা। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখের কোল বেয়ে জল নেমে আসে। রাতের অন্ধকার নেমে আসে জিয়ার মনে।
এক সপ্তাহ কাটার পরেই জিয়ার মন বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়। মাকে জানায় তার আর ভালো লাগছে না এখানে সে ফিরে যেতে চায়। হটাৎ জিয়াকে তার মা প্রশ্ন করে ' জিয়া তিমিরকে তোর ভালো লাগে? দেখ আমার বয়স হচ্ছে আজ বাদে কাল কিছু হয়ে গেলে তুই একা থাকবি এটা ভাবতেও পারিনা। আমায় তিমিরের পিসিমা ফোন করেছিলেন ওরা তোদের বিয়ে দিতে চায়, আমি কিছু উত্তর দিতে পারিনি বলেছি তুই ফিরলে তোর সাথে কথা বলে জানাব। এবার তুই বল তুই কি চাস?' জিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাকে বলে 'মা তিমির এমন একটা মানুষ যাকে ভালো না বেসে থাকা যায়না। আমায় তিমির অনেক আগেই প্রস্তাব দিয়েছিলো কিন্তু কোন জোর করেনি। আমি কিছু বলতে পারিনি মা, আমিও ওকে ভালোবাসি বলতে পারো শ্রদ্ধা করি।' এবার তুমি যা ভালো বোঝো কর। আমি ফিরে আসব এমাসের শেষেই, আমার এখানে ভালো লাগছে না।'
জিয়া তিমির কে মেসেজ করে, দুজনকথা বলে ঠিক এইভাবে...
-এক শর্তে বিয়ে করতে রাজি
- তুমি যা চাও জিয়া তাই হবে বল কি?
- আমি বিয়ে করতে আসব তোমার বাড়িতে, তুমি আসবে না কলকাতায়।
- রাজি রাজি রাজি, আর কি চাও?
- আমার কোন আত্মীয় আসবে না, আমায় মা সম্প্রদান করবে। শুধু তোমার গ্রামের লোকরাই নিমন্ত্রিত হবে।
- এই জন্যই তো জিয়া তোমায় প্রথম দেখায় ভালোবেসেছি, আমি ভুল হতেই পারিনা। তোমার ফেরার অপেক্ষায় রইলাম।
- খুব জলদি আসব তিমির তোমার হয়ে আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর।
মাস খানেক পর জিয়া দমদম এয়ারপোর্ট থেকে সোজা গাড়ি নিয়ে তিমিরের বাড়িতে রওনা হয়, তিমির নিজেই এসেছে নিয়ে যেতে তাকে। মা দুদিন আগেই চলে গেছে তিমিরের বাড়িতে। গাড়িতে উঠে জিয়া প্রথম তিমিরের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে ' আমায় ক্ষমা করে দিও সেই মুহুর্তে তোমায় কিছু বলতে পারিনি। যত দূরে গেছি ততই বুঝতে পেরেছি তোমার গুরুত্ব আমার জীবনে কতটা। ভালোবাসি তিমির।' তিমির মুচকি হেসে বলে 'সেতো অনেক আগেই বুঝেছি শুধু তোমার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় ছিলাম জিয়া। আরেকটা কথা বলি যদি কিছু মনে না কর, কলকাতার বাড়িটা তালা বন্ধ থাক তোমার যখন ইচ্ছে হবে গিয়ে থেকো, মাসিমনি মানে মাকে আমাদের কাছেই রাখব। ওনার আর একা থাকা ঠিক হবেনা। আমি তো আছি সব সামলে নেব। এবার তুমি কি চাও বল?' জিয়া বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে দেখে তিমিরকে ভাবে কি করে জিয়ার মনের ইচ্ছে তিমির বুঝতে পারল! জিয়া বলে আমার সব দায় তো তোমারই তাই যা তুমি ভালো মনে করবে তাই হবে।
বাড়ি সামনে কতরকমের ফুল আমপাতা শোলার কদমের মালা দিয়ে সাজানো। পথে আলপনা দেওয়া সুন্দর করে। জিয়ার চোখ খুশিতে ছলছল করে ওঠে, সেকি স্বপ্ন দেখছে! বাড়িতে ঢোকার সময় শাঁখ উলুধ্বনিতে চারপাশ মেতে ওঠে, উঠান জুড়ে গ্রামের নানা বয়সের মহিলারা তাকে স্বাগত জানায়। সে উপরে গিয়ে মা পিসিমা আর তার হবু শাশুড়িমাকে প্রণাম করে। এরপর সবাই মেতে ওঠে বিয়ের আনন্দে।
বিয়ের সব অনুষ্ঠান ভালো ভাবে শেষ হয়, আর তিমির তার প্রতিটা কথাই রাখে। গ্রামের লোক তিনদিন ধরে নেমনতন্ন খায় আর ওদের প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করে। বৌভাতের রাতে তারা রাধামাধব কে প্রণাম করতে আসে। জিয়া চেয়ে থাকে যুগলমূর্তির দিকে। মনে মনে বলে তুমি আমার জন্য এত ভালো কিছু ঠিক করে রেখেছিলে ঠাকুর, তাই সেদিন আমি আনমনে তোমার অচিনপুরে নেমে গেছিলাম। তারা ঠাকুরকে প্রণাম করে সুন্দর জীবন শুরু করে। সেই রাতে জিয়া তিমিরকে তার সামনে বসিয়ে একটা পোট্রের্ট এঁকে উপহার দেয় আর বলে তোমায় দেওয়ার মত আর কিছু মাথায় আসেনি। তিমির অভিভূত হয়ে দেখে জিয়াকে তারপর তাকে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে, আর বলে 'সবচেয়ে দামী উপহার তুমি নিজেই জিয়া, এমনই থেকো আজীবন সহজ সরল আর অল্প পাগল।' দুজনেই হেসে ওঠে....
শেষ।
আসলে জিয়ারা কোনদিন তাদের তিমিরকে খুঁজে পায়না। তাই সব চরিত্রই কাল্পনিক।
No comments:
Post a Comment