Friday 15 October 2021

শারদীয় সংখ্যা ~ জর্নাল লিখলেন অরিজিৎ চক্রবর্তী

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা || শারদীয় সংখ্যা||  জর্নাল লিখলেন 
                                                                        অরিজিৎ চক্রবর্তী 


লাভ-প্যাডলক, আইফেল টাওয়ার আর অপেক্ষারত অ্যালিসের গল্প

প্যারিসে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর দুটো ,অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে দীর্ঘ পনেরো ঘন্টা ফ্লাইটে জার্নি করার পর এই অবতরণের ক্লান্তি, উৎসাহে এতটুকু শিথিলতা আনেনি। এয়ারপোর্টের বাইরে বৃষ্টি আর দূরে অপেক্ষারত অ্যালিসের হাতনাড়া দেখে  মনে পড়ল অঞ্জন দত্তের সেই গানটা 'আমি বৃষ্টি দেখেছি, বৃষ্টির ছবি এঁকেছি...' কিন্তু এটা প্যারিস। তাই মন গুনগুনিয়ে উঠল ‘Rappelle-toi Barbara, Il pleuvait sans cesse sur Brest ce jour-là, Et tu marchais souriante..’- ‘ মনে কর বারবারা, সেদিন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল, আর তুমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলে, হাসিমুখে..’ সেই হাসি মুখের মায়াবী আলোয় যখন ভেসে যাচ্ছি... ভিজে যাচ্ছি... আমি! ঠিক তখনই এই লেখার খেয়ালি লক্ষ্যের দিকে Bienvenue ( বিয়াভ্যন্যু ) যার বাংলা করলে "স্বাগতম"! সারা শহর জুড়ে লেখা এই শব্দটা যেন ফরাসি পর্যটনের অভিমুখ হয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

ফরাসী ভাষাকে ভালোবাসার ভাষা আর প্যারিসকে বলা হয় ভালোবাসার শহর। শ্যেন নদী প্যারিসকে ভালোবেসে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে; একইভাবে শৈল্পিক সব স্থাপত্যশৈলী এই নদীর উপরেই প্রায় ৩৭ টি ব্রীজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ব্রীজগুলোর উপর দিয়ে হাঁটতে গেলেই যে কেউ টের পাবে ব্রীজের রেলিংগুলোতে এক ধরণের বিশেষ তালা ঝুলে আছে। এগুলোকে “লাভ প্যাডলক” বলা  হয়।প্যারিসের পন্ট ডেস আর্টস ব্রিজ, আবেগ এবং বিশ্বস্ততার প্রতীকের এমনই এক উদাহরণ। 

প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা যে কোনো একজন অন্যজনের নামের আদ্যক্ষর দেয়া একটি তালা ব্রীজের রেলিংয়ে বেঁধে রাখেন এবং চাবিটি ফেলে দেন শ্যেন নদীতে। চাবি হারিয়ে যাওয়ার ফলে তালা কখনো খুলে যায় না; ঠিক তেমনি প্রেমিক-প্রেমিকার বন্ধনও যেন জন্ম জন্মান্তর অটুট বন্ধনেই বাঁধা থাকে। এমনটাই প্রত্যাশা করে বাঁধা  হয় এই তালাগুলো। প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার এমন নিদর্শনের কারণেই প্যারিস ভালোবাসার শহর হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। আর অদ্ভূত ভাবেই আমি জড়িয়ে গেছি সেই ভালোবাসার মায়াবী বন্ধনে। অ্যালিসের সঙ্গে বন্ধুত্ব গভীর হয়েছে। সেই আমাকে প্যারিস শহরটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে চেনানোর চেষ্টা করছে। আমি উঠেছি নীলের কাছে। নীল কলকাতার ছেলে। সিটে ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার জন্য এসেছে। ও আরো দুজন সহপাঠী কে নিয়ে একটা ঘর ভাড়া করে থাকে। নিজেরাই রান্না করে খায়। নীলের সঙ্গে যে দুজন থাকে তাদের একজন বাংলাদেশী আর অন্যজন রাশিয়ান। অনেকটা আমাদের এখানকার মেসের মতো। ফলে এখানে থাকার একটা মজা আছে। হৈহৈ আছে। তাছাড়া হোটেলের মতন ব্যয় বহুল নয়। আমিও ওদের খরচে কিছুটা শেয়ার করে দিই। পনেরো কুড়ি দিনের সফর দিব্যি কেটে যায়।

প্যারিস শহরটি ইউরোপ জুড়ে পারি নামেই পরিচিত। এই পারিকে সিটি অফ লাইটস বা আলোকিত শহরও বলা হয়। কাগজে কলমেও প্যারিসের নাম “লা ভিল্লা ল্যুমিয়ের"। ইউরোপের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় প্যারিস ইউনিভার্সিটি (লা সোরবোন্নে) এর জন্য ইউরোপের অন্যতম জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থভূমি ছিল এই প্যারিস। আর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়েই ইউরোপের প্রথম শহর হিসেবে প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় প্রথম গ্যাস চালিত ল্যাম্পপোস্ট স্থাপিত হয়। সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকারে যখন পুরো ইউরোপ তলিয়ে যেত তখন প্যারিস স্বমহিমায় আলো ঝলমলে এক রূপ নিয়ে সবাইকে চমকে দিত। আর তাই তো সিটি অফ লাইটস বা আলোকিত শহর নামে এখনও পরিচিত প্যারিস। 

আজ অ্যালিসের সঙ্গে আইফেল টাওয়ার ভ্রমণে যাব। লাচাপেল ( La Chapelle ) থেকে আইফেল টাওয়ারের দূরত্ব পঁয়তাল্লিশ মিনিট। প্রথমে পায়ে হেঁটে ভিক্টর হুগো 
( Victor Hugo) পৌঁছলাম। সেখানে থেকে  ৮২ নং বাসে ট্যুর আইফেল ( Tour Eiffel) প্রায় মিনিট কুড়ির রাস্তা।

১৮৮৯ সালে গুস্তাভ আইফেল বিশ্বমেলার প্রবেশদ্বার হিসেবে নির্মাণ করেন এই টাওয়ার। তখনকার সময়ে ব্যাপক সমালোচনার স্বীকার হয় টাওয়ারটি। এমনকি এটি সরিয়ে ফেলতে প্যারিসের রাস্তায়ও নেমেছিল একদল মানুষ। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দী থেকেই প্যারিস তথা ফ্রান্সের প্রতীকে পরিণত হয় আইফেল টাওয়ার। ফ্রান্সে ঘুরতে গিয়ে আইফেল টাওয়ার না দেখা ফ্রান্সে না যাওয়ারই সমতুল্য বলে মনে করেন অনেকেই। প্রতি বছর গড়পড়তা প্রায় ৭০ লাখ মানে ৭ মিলিয়ন পর্যটক কেবল প্যারিসের এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য দেখতে আসে। আঠেরো হাজার আটত্রিশটি লোহার টুকরোর সমন্বয়ে তৈরি এই স্থাপত্যশৈলী বর্তমানে প্যারিস তথা ফ্রান্সের প্রতীক বলে বিশ্বব্যাপী মর্যাদা পেয়েছে। 
               অ্যালিসের সঙ্গে
এখন আমি ট্যুর আইফেল থেকে অ্যালিসের হাত ধরে আইফেল টাওয়ারের দিকে এগিয়ে চলেছি। আমার মনের রসায়নে যে মুহূর্ত প্রেমের উদ্দীপনা তৈরী হয়েছে তাকে অস্বীকার করার মতো ধৃষ্টতা আমার নেই। কারণ অ্যালিসের সৌন্দর্যে যে কোন পুরুষই মুগ্ধ হবে।
টাওয়ারের মূল কাঠামো চারটি বিশাল লোহার পিলারের উপর তৈরী। জানা যায় ২৫০ জন নির্মানকর্মী দুবছর পাঁচ মাস সময় ধরে তৈরী করেছেন এই টাওয়ারটি ।আইফেল টাওয়ার দিনের চেয়ে রাতে দেখতে বেশী সুন্দর ।
      
আইফেল টাওয়ারে লাগানো আছে বিভিন্ন রংয়ের অসংখ্য আলো ।এই আলো গুলো যখন রাতে  জ্বালানো হয় তখন টাওয়ারের পুরো এলাকাকে অপূর্ব সুন্দর করে তোলে। এক সংগে ছয় হাজার দর্শনার্থী আইফেল টাওয়ারের ছুড়ায় উটতে পারে। টাওয়ারের মোট উচ্চতা এক হাজার ৮১ ফুট ৭ ইঞ্চি । টাওয়ারের চূড়া থেকে পুরো প্যারিস সিটির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। পাশ দিয়ে বহমান শ্যেন নদী। নদীতে আবার রয়েছে ক্রুজ লাইন । এখানে পর্যটকরা নৌভ্রমনের মাধ্যমে আইফেল টাওয়ার এর সৌন্দর্য উপভোগ করে থাকে।

যখন আইফেল টাওয়ারের সামনে এসে পৌঁছলাম তখন বিকেল। অ্যাসিসের মুখে সেই ভালোবাসার হাসি। হঠাৎ আমার কাঁধে হাত রেখে কয়েকটা সেলফি তুলল। তারপর টাওয়ারের উপরে ওঠার টিকিট কেটে আমাকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে গেল লিফটের দরজায়। খানিকক্ষণ বাদেই পৌঁছলাম আইফেল টাওয়ারের চূড়োয়। সেখান থেকে নিচের লোকজন গাড়ি সমস্ত কিছুকেই মনে হচ্ছিল গ্যালিভারের গল্পের লিলিপুটদের মতো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যালিসের কাঁধে কাঁধ রেখে হাতে হাত রেখে আমি তখন সমগ্ৰ প্যারিসের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো। জ্বলে উঠলো টাওয়ারের সমস্ত আলো। নিচে শ্যেন নদীর জলে সেই আলোর অবারিত আলপনা। ভাসমান ক্রজ। অ্যালিসের ডাকে ঘোর কাটল। আইফেল টাওয়ারের উপর ফিফটি এইট ট্যূর আইফেল রেস্তোরাঁয় আমরা দুকাপ কফি নিয়ে বসলাম। কফিতে চুমুক দিতে দিতে ঠিক কখন যে এই ফরাসি নারীর চোখের অতলে হারিয়ে গেলাম! আজও ঠিক মনে করতে পারি না!  


2 comments:

  1. কফিতে নির্ঘাত চিনি কম ছিল

    ReplyDelete
  2. ঝরঝরে ভ্রমণ আখ্যানটি পড়ে চোখের সামনে যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠল প্যারিস।

    ReplyDelete