Friday, 15 October 2021

শারদীয় সংখ্যা ~গল্পে শিশির পাল

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা || শারদীয় সংখ্যা|| গল্পে শিশির পাল 


নতুন আলো


চরম হতাশা নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটছে সাগর। আজ আর বাড়ি ফিরবে না ও। কিছুতেই না। বেঁচে থাকার ইচ্ছে যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, সেটাও শেষ করে দিয়েছে নীলা। বেকারত্ব, অপ্রেম, অপমান আর উপেক্ষায় ধুঁকতে থাকা জীবনের শেষ অবলম্বন নীলাঞ্জনাও তাকে ত্যাগ করেছে। এই পৃথিবী ওর মতো নিঃস্বদের জন্য নয়। এই পৃথিবী অর্থের। ভোগের।লোভের। ছোট থেকে লালন করা জীবনের সারমর্ম, অমোঘ সমীকরণ সব আজ অর্থহীন সাগরের কাছে।

শহরের গা ঘেঁষে চলে গেছে দ্বারকেশ্বর। এই ফাল্গুনে তারও হাঁটুজল। নদীটিও যেন কোনও সমাপ্তিকে ইঙ্গিত করছে। শেষ হওয়ার মন্ত্র শোনাচ্ছে। বসন্তের কোকিল এই ভোর বেলায় কুহু কুহু ডাকলেও সেটা আর সাগরের জন্য নয়। রাত্রের কালো আকাশ চিরে আলোর আভা ফুটছে আস্তে আস্তে।রক্তিম আলোর পুব আকাশ, ভোরের শান্ত আবহ আর অনেক স্বপ্ন নিয়ে শুরু হচ্ছে আর একটা নতুন দিন। খুব জোরে পা চালাচ্ছে সাগর। যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে ও আর নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। ও পৃথিবী থেকেই সরে যাবে আজ। হাঁটতে হাঁটতে ও ঢুকে পড়ে জঙ্গলে।

কাল সন্ধে বেলায় টিউশন পড়িয়ে সাগর বাড়ি ফিরে দেখল, ওর মা লোকের বাড়ির কাজ সেরে উঠোনে এসে বসে আছে।অদ্ভূত থমথমে মুখ। অত্যাচারী বাবা ওদেরকে ত্যাগ করে যেদিন অন্য সংসার পেতেছিল সেদিনই সাগর ঠিক করেছিল ও মা কে কখনও কষ্ট দেবে না। দাঁতে দাঁত চেপে রাত দিন এক করে পড়াশুনো করেছে। বাড়ির কাজ, লোকের বাড়িতে ফাইফরমাস খাটা, টিউশন পড়ানো এসবের ফাঁকে সে পিএইচডিও কমপ্লিট করে রেখেছে। বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে সরকারি চাকরির। কোথাও কোনও চাকরি সে পায়নি।চোখের সামনে কোনো আশার আলোও নেই। চারিদিকে শুধুই ব্যর্থতার ছবি।
"সাগর।কী চাস তুই? আমাকে বাঁচতে দিবি তো?"
"এরকম বলছ কেন মা? কী করেছি আমি?"
"বিমলবাবুর লোক, পার্টির দাদারা এসেছিল একটু আগেই।শাসিয়ে গেছে। কথা দে তুই,নীলাঞ্জনাকে ভুলে থাকবি। ওর কাছে আর যাবি না। এই ফাল্গুনের শেষেই ওর বিয়ে।"
বেশ রূঢ় লাগে সাগরের মা কে। সাগর স্তম্ভিত। বোবা হয়ে গেছে যেন। কোনও রকমে বলে, "বিয়ে! এই ফাল্গুনেই! কিন্তু...।"
সাগরের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর মা বলে, "এটা তো হওয়ারই ছিল। তোর কী আছে? টাকা আছে? বাড়ি? গাড়ি?চাকরি? নিদেনপক্ষে সামাজিক পরিচয়! সেটা নিয়েও তো লোক হাসাহাসি করে! বিমলবাবুর অমন চাঁদের টুকরো মেয়ে আসবে তোর মতো এই ধুলোমাখা ছেলের কাছে? কোনও মেয়ে আসবে? আসবে না। আসতে পারে না।"
বলতে বলতে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সাগরের মা। এক প্রবল অন্যায়বোধে নিজেকেই চড় মারে সাগর। সন্ধের আলো আঁধারিতে নিজেকে আততায়ী মনে হয়। ও তো খুন করতে চলেছে ওর মাকে। নিজেকে। এই পাপ থেকে কী করে শুদ্ধ করবে নিজেকে!

জঙ্গলের অনেকটা গভীরে এসে বসে পড়েছে সাগর। তার ক্লান্ত শরীরে প্রবল তৃষ্ণা। পাখি ডাকছে। পলাশ গাছের নিচে বসে আছে। নির্বাক। স্থবির। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। প্রাক আত্মহননের প্রস্তুতি করছে হয়তো মনে মনে। তার চোখ আনত। সে দেখে মাটিতে থরে থরে পড়ে আছে পলাশ ফুল।অনাদরে। তারাও সাগরের মতো ক্ষয়িষ্ণু।

হঠাৎ কী মনে হয়, যেন এক বুনো ঝোঁক ওকে পেয়ে বসল। উঠে পড়ল গাছের ডালে। ব্যাকপ্যাকের ভেতর রাখা দড়িটা বের করে ডালে বাঁধল বেশ শক্ত করে। একটা ফাঁস বানাল এমন ভাবে যেন ওটা গলায় লাগিয়ে লাফ দিলে ওর অবস্থান মাটির কিছুটা উপর থাকে। মৃত্যুকে নিশ্চিত করতে এই মুহূর্তে ও মরিয়া।

জঙ্গলের গভীরতায় এক নৈঃশব্দ ছেয়ে ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ মানুষের হেঁটে আসার শব্দ। শিশুর কান্নার শব্দ ভেসে আসতে লাগল। ক্রমশ গাঢ় হতে লাগল শব্দটা। আর দেরি নয়। লাফ মারল সাগর।

জ্ঞান ফেরার মুহূর্তে আবছা দৃষ্টিতে সাগর দেখতে পায় তাকে ঘিরে আছে একটা মূর্তির মতো মুখ। অধৈর্য। আকুল।

গাছের ভাঙা ডালটা পড়ে আছে পাশে। শিশুর কান্না থেমে গেছে। কৃষ্ণদেহী অপরূপা মহিলার মুখের অভিব্যক্তি আস্তে আস্তে পাল্টাচ্ছে।
" কেন মরতে যাচ্ছিলে ! কেন ! এই এই দ্যাখো, পাঁচ বছর আগেই স্বামী আমাকে ছেড়ে অন্য মহিলার সঙ্গে সংসার করছে। আমার বাবা নেই। মা নেই। এই দুটো বাচ্চা আর আমি। তবুও তো বেঁচে আছি। আমার ছেলেরা আমাকে মা বলে। আমাদেরও আবেগ আছে। ভালোলাগা আছে।ভালোবাসা আছে। কষ্ট আর সমস্যা আমার জীবনকে থামাতে পারেনি।"
অবসন্ন সাগর দেখে মহিলার শক্ত চোয়াল। ঝিনুকের ভেতর রাখা মুক্তোর মতো অমূল্য জীবন দর্শন। মহিলা আবার বলে,"চলো। হাত ধরো। কাছেই আছে প্রাথমিক চিকিৎসালয়।"

পলাশ গাছের ডাল ঝাঁকিয়ে একটা পাখি উড়ে গেল। দূর আকাশে। এক নিবিড় সংকেত বুঝি রেখে গেল! ঝরে পড়ল আরও কিছু পলাশ ফুল। পুষ্প বৃষ্টির মতো। মহিলার হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সাগর। পা রাখল সামনের পথে।


No comments:

Post a Comment