দেশপ্রেমিক উর্দু কবি জিগর মুরাদাবাদী....
বিংশ শতাব্দীর উর্দু সাহিত্যের মহান কবি জনাব জিগর মুরাদাবাদীর জন্ম 1890সালে মুরাদাবাদে। জিগর মুরাদাবাদীর আসল নাম আলি সিকন্দর। বংশ পরম্পরায় তিনি কাব্য প্রতিভা লাভ করেছিলেন। তাঁর পিতা মৌলবি আলি নজ়রও কবি ছিলেন। জিগর সাহেবের পিতা তৎকালিন সময়ের বিশিষ্ট কবি খ্বাজা ওয়াজির লক্ষৌভীর শিষ্য ছিলেন। তাঁর কাব্য সংগ্রহের নাম..."বাগ এ নজ়র। জিগর সাহেবের প্রাথমিক শিক্ষা ঘরেই হয়,পরে মক্তবে ভর্তি হ'ন। ছোট থেকেই কবিতা লিখতেন। এবং তাঁর পিতা তাঁর কবিতা সংশোধন করে দিতেন। পরে দাগ় দেহলভী,মুন্শি অমীরুল্লা 'তস্নিম 'এবং রসা রামপুরীকে নিজের লেখা গ়জ়ল দেখাতেন। স্কুলে পড়াশোনার সময় থেকেই তিনি গ়জ়ল লিখতেন,কিন্তু ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ওইসব গ়জ়ল প্রকাশ্যে আনেননি।
জিগর সাহেব পরে চশমা তৈরির এক কোম্পানিতে সেল এজেন্টের চাকরি করেন। এইভাবে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে তাঁকে অর্ডার আনতে হতো। শরাবে তাঁর প্রবল আসক্তি ছিলো। ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি সুরাসক্ত হয়ে পড়েন। সে সময় কবিতা এবং শরাব তাঁর নিত্য সঙ্গী ছিলো। সেই যুগে তিনি ঘুরতে ঘুরতে গোন্ডা পৌঁছন,যেখানে বিশিষ্ট উর্দু কবি অসগর গোন্ডভীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁর প্রতিভাকে চিনতে অসগর সাহেবের কাল বিলম্ব হয় না। ওনাকে শোধরানোর চেষ্টায় নিজের শ্যালিকা নসীমের সঙ্গে জিগর সাহেবের বিবাহ দেন। এইভাবে জিগর সাহেব তাঁর ঘরের এক সদস্য হয়ে ওঠেন। কিন্তু ভ্রমণ,'শায়রি এবং শরাব জিগরকে এমন ভাবে আঁকড়ে ধরেছিল যে,বিবাহিত জীবন বন্ধনও তাঁকে বেঁধে রাখতে পারেনি। বিভিন্ন স্হানে ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে ততদিনে বিভিন্ন জায়গায় কবি হিসাবে তাঁর পরিচিতি লাভ হয়ে গেছিল।
জিগর সাহেব অতীব দয়ালু প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন। কারো দুঃখ কষ্ট দেখতে পারতেন না। তিনি কাউকে ভয় পেতেন না। লক্ষৌর ওয়ার ফান্ডের জন্য আয়োজিত মুশায়ারাতে,যার পৌরহিত্য করেছিলেন এক ইংরেজ সাহেব; সেই মুশায়ারাতে "কহত এ বঙ্গাল "(বাংলার দুর্ভিক্ষ)কবিতা পড়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন।
বেশকিছু রাজ্যপ্রধান তাঁকে নিজেদের দরবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চাচ্ছিলেন। জিগরের সমস্ত শর্ত মানতে রাজি ছিলেন। কিন্তু তিনি বারবার তা প্রত্যাখ্যান করে গেছেন। তাঁকে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব দিতে সাগ্রহে আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালিন পাকিস্তানি সরকার। নাগরিকত্ব সহ সমস্ত রকম আরাম আয়েশ ও জীবনের নিশ্চয়তার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও জিগর সাহেব বলেছিলেন..."আমি যেখানে জন্মেছি,সেখানেই মরতে চাই।"
জিগর সাহেব কোনদিন নিজের সুরাসক্তির জন্য গর্ব বোধ করেন নি,পরবর্তী কালে তিনি বরাবর বলেছেন ...."ওটা ছিলো জ্ঞানহীনতার যুগ "।
যাইহোক,শরাব ছেড়ে দেবার পর রামি খেলায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে জিগর সাহেব প্রচন্ড ধার্মিক হয়ে পড়েছিলেন। 1953সালে তিনি হজ যাত্রা করেন। জীবনের প্রতি উদাসীনতা এবং বেপরোয়া জীবনযাত্রা তাঁর মন মস্তিষ্ককে ধ্বংস করে দেয়। 1941সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। 1958সালে মস্তিষ্ক বিকৃতি হয়। লক্ষৌতে তিনি দু বার হৃদরোগে আক্রান্ত হন।
ঘুমের ওষুধ খেয়েও সারারাত তাঁর ঘুম আসতো না। 1960সালে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মৃত্যু সন্নিকটে। নিজের জিনিস পত্র স্মৃতি স্বরূপ লোকজনকে দান করে দিতে শুরু করেন। তাঁর অত্যন্ত প্রশংসিত কাব্যগ্রন্থ..."আতিশ এ গুল "এর জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। জিগর মুরাদাবাদী আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে কেবলমাত্র দ্বিতীয় কবি,যাঁকে ডি লিট সম্মানে সম্মানিত করা হয়। এই সম্মান প্রাপক প্রথম কবি ডক্টর স্যার মুহম্মদ ইক়বাল। জিগর মুরাদাবাদী 1960সালে 9ই সেপ্টেম্বর গোন্ডাতে মারা যান। তাঁর দুটি বিখ্যাত শের....
তেরি খুশি সে অগর গ়ম মেঁ ভী খুশি না হুয়ী
ওহ জ়িন্দগী তো মুহব্বত্ কী জ়িন্দগী না হুয়ী।
হমনে সীনে সে লগায়া,দিল্ না অপনা বন
সকা
মুস্কুরা কর তুমনে দেখা,দিল্ তুম্হারা হো
গ্যায়া। "
No comments:
Post a Comment