Friday, 15 October 2021

শারদীয় সংখ্যা ~শিকড় মানব পবন লোহার

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা || শারদীয় সংখ্যা||  শিকড় মানব পবন লোহার 
সুব্রত পণ্ডিতের কলমে 


নমস্কার পবন দা।

নমস্কার সুব্রত। এসো এসো ভাই।

কেমন আছেন দাদা, এই কোভিডাবস্থায়?

ভালো আছি সুব্রত। এসো এসো।খুব ভালো লাগলো। অনেকদিন পর, সেই পরিচিত মুখ।আপ্লুত করল আমাকে।

দাদা মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকার তরফ থেকে আপনার সাথে কিছু কথা বলতে এসেছি।আপনি যদি আপনার ব্যস্ত সময় থেকে কিছুটা  সময় আমাদের দেন।

অবশ্যই। মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা তো আমারও পত্রিকা।সেই কবে থেকে তোমাদের সাথে পরিচয়।অভিজিৎ ও তো আমার খুবই ভালোবাসার এবং স্নেহের মানুষ।বড্ড চনমনে ছেলে।
আরে কী যে বলো সুব্রত, আমি তো অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। আমার তেমন কোনো বিশেষ ব্যস্ততা নেই,এই সংসারের কিছু টুকটাক কাজ,তারপর এই কাটাম-কুটুম নিয়ে সময় কাটাই।এসো এসো ভাই গল্প করি।


১) দাদা আপনিতো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে চাকরি করেছেন। সারাটা দিন ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সময় কেটেছে। কীভাবে এই কাটাম কুটুম শিল্প গড়ার প্রেরণা পেলেন?

➤ হ্যাঁ একসময় প্রধান শিক্ষকের পদে ছিলাম,বর্তমানে তো জানোই ভাই, অবসর গ্রহণ করেছি।ছাত্রাবস্থা থেকে ছবি আঁকার প্রতি একটা নেশা কাজ করতো।১৯৭৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার পর জুলাই মাসে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম, এক ভদ্রলোকের কাছে।কলা ভবনে ভর্তির আশা নিয়ে,কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি।তবে তিনি আমাকে বিশ্ববিখ্যাত ভাস্কর শিল্পী রামকিঙ্কর বেজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন,এবং রবীন্দ্র মিউজিয়াম ঘুরিয়ে দেখিয়ে ছিলেন,সেখানে অবন ঠাকুরের তৈরি কাটাম-কুটুম দেখেছিলাম।
তারপর কেটে যায় বহুবছর, সম্ভবত ১৯৮৩-৮৪ সালে আমার গ্রামের এক বোন( রীনা ব্যানার্জি) ছান্দারে বেসিক ট্রেনিং নিতে যায়,সে গাম শিখত এবং সে কারণে অভিব্যক্তির প্রাণ পুরুষ উৎপল চক্রবর্তীর নজরে আসে,এবং তখন সে তাঁকে আমার সম্পর্কে বলে।উৎপল বাবু আমাকে দেখা করতে বলেন।আমি অভিব্যক্তি যাই,বেশ আকর্ষণ করতো, তাই বারবার ছুটে গেছি।ছবিও আঁকতেও থাকি।একসময় মনে হোলো ছবি এঁকে বেশিদূর এগোতে পারবো না।ছান্দারে কাটাম-কুটুম দেখলাম।মনে মনে ভাবলাম এগুলোতো আমিও জোগাড় করতে পারি।শুরু হোলো সংগ্রহ। প্রথম প্রথম এখানে ওখানে দিতাম।এখন আর দিই না।বাম আমলে গণনাট্যের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এবং গ্রামীণ মেলাগুলোয় প্রদর্শনী হতে লাগলো।আমার আঁকা ছবি আর কাটাম-কুটুম বাহবা পেতে শুরু করলো।আর এই বাহবাই আমার অনুপ্রেরণা।


২) দাদা আপনি একটি গ্রামে জন্ম থেকে বেড়ে উঠেছেন?এই রকমের শিল্প নিয়ে আপনি এতোটা পথ এগিয়ে এলেন।কী ধরনের প্রতিকুলতা আপনাকে কাটিয়ে উঠতে হয়েছে।সাংসারিক এবং সামাজিক। যদি একটু আমাদের জানান__

➤ হ্যাঁ আমি তো বিষ্ণুপুর ব্লকের অধীনে চুয়ামসিনা গ্রামে জন্মেছি। এখানেই বেড়ে ওঠা,বন্ধু বান্ধব। আমার বাবা-মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের সাথে। আমার পড়াশোনার পিছনে আমার বন্ধু বান্ধবদের অবদান কখনো ভুলব না।বিশেষ করে মুক্তেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণদাস গাঙ্গুলি, মহীতোষ মুখোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় এঁদের।কিছু মাস্টার মশাই আছেন নিরঞ্জন দত্ত,রাখাল চন্দ্র তা,বিশ্বনাথ ঘোষ মহাশয়েরা। আমার বাবা মা উভয়েই নিরক্ষর ক্ষেত মজুর ছিলেন,দরিদ্রতা, অভাব অনটন,তবুও ছেলে পড়াশুনা করে একটি জায়গায় উত্তীর্ণ হোক এটা ছিল তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। সংসারে দরিদ্রতা সত্বেও আমাকে  কখনো কাজ করতে দেয় নি।
আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় এ ধরনের কাজ করতে গিয়ে কোনো শিল্পীই অনুকূল পরিবেশ পাননি।বাঙালি সমাজ এবং সংসার সেই বাঙালি কাঁকড়ার মতো,কাওকে সহজে উঠতে দেবে না।তাহলে আমি বা তুমি (সুব্রত) মুক্তি পাবো? আমিও তার শীকার হয়েছি বারবার।আমার যা ক্ষতি হয়েছে, তার থেকে বেশী সংসার এবং সমাজের ক্ষতি হয়েছে,কারণ আমি যা করতে চেয়েছিলাম তার আংশিক যদি করতে পারতাম,তাহলে অনেকের সংসার নির্বাহ হতো।যুব সমাজের আয়ের পথ খুলে যেত। কারণ বিশ্বব্যাপি  এই শিল্পের বাজার আছে।সেটা ধরতে পারলেই...

৩) আচ্ছা পবন দা,আপনার এই শিল্পের প্রতি এতো যে নিষ্ঠা, প্রেম। আপনি কীভাবে উপাদানগুলো সংগ্রহ করেন?

➤ এই কাজ বা শিল্পের প্রতি নিষ্ঠা বা প্রেম যাই বলো সুব্রত,১৯৮৪ সাল থেকে। এর উপাদান সংগ্রহের জন্য বনে-বাদাড়ে যেতাম।তারপর একটা সময় এলো মনে প্রাণে ব্যাপারটা গেঁথে গেলো।যেহেতু ছবি আঁকতাম, ফলে জীব-জন্তু, মানুষ,পাখির অবয়ব লক্ষ্যে সহজেই ধরা পড়তো। ফলে রাস্তায় যখন বের হই মরা গাছ বা শিকড়ে এধরনের আদল বা অবয়ব দেখলেই নজর পড়ে,তা থেকে কী হতে পারে মন বলে দেয়, ফলে বাড়ি নিয়ে আসি,কোন অংশ অতিরিক্ত সেটা বাদ দিই। এভাবেই এরা আমার সংসারে বসবাস করে। এদের দেখি আর এক অনাবিল আনন্দ পাই। আর এই আনন্দ উপাদান সংগ্রহ করতে সাহায্য করে।


৪) পবন দা,আপনার এই কাটাম কুটুম শিল্পে নিজেকে নিয়োজিত করার জন্য কার অনুপ্রেরণা পেয়ে এসেছেন?

➤ ওই যে আগেই বলেছি তোমায়,বিভিন্ন ক্লাব, গণনাট্যের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রদর্শনী হতো।একবার রাধানগরে সরকারি ভাবে একটি গ্রামীণ মেলা হয়েছিলো, সেখানে আমার কাজের প্রদর্শনীও ছিল।বহুমানুষ। আধিকারিকরা ছিলেন। ওনারাও দেখেছিলেন এবং প্রশংসাও করেন। এই ব্যাপারটি আমার বাবা লক্ষ্য করেন,আমাকে বলেন পড়াশুনার মতো এই কাজটিও মনযোগ সহ করে চলো।বাবা নিরক্ষর ছিলেন,তবুও শিল্প এবং শিল্পীর প্রতি অনুভব ছিল। এবার আমিও মানুষের ভালোবাসায় আমার কাটাম-কুটুম এর কাজ করতে থাকলাম।

৫) পবন দা,এই কাটাম কুটুম শিল্পের বাণিজ্যিক গুরুত্ব কতটা, বলে আপনার ধারনা?

➤ প্রতিটি শিল্পেরই বাণিজ্যিক গুরুত্ব আছে,আর ভবিষ্যতেও থাকবে এবং বাড়বে। কাটাম-কুটুম একটি রেয়ার শিল্প, এই শিল্প কোনো স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখানোর ব্যবস্থা নাই।যেকজন করেন,তাঁরা নিজেদের স্বভাব থেকেই করে থাকেন।আমিও তাই।
তবে বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনী করতে গিয়ে দেখেছি মানুষ কিনতে চায়।তবে আমারতো বিক্রির তাগিদ নাই,আমি চাকুরিজীবী  আমার তাগিদও কম।সুব্রত, শান্তিনিকেতনে দেখেছি প্রতি শনিবার খোয়াই-এর হাটে কাটাম-কুটুম কেনা বেচা হয়।এছাড়া ভুবনডাঙার মাঠে বিভিন্ন স্টলে কাটাম-কুটুম রাখা আছে এবং বিক্রিও হয়।তবে কী যানো সুব্রত, সেই মাত্রায় কাজটা করতেও হবে।যা মানুষকে মুগ্ধ করবে,তবে এটাও ঠিক,শিল্প রসিকদের কাছেই এর মূল্য।


৬) আচ্ছা দাদা, আপনি যে এতো বছর এই শিল্পের সাথে নিজেকে যুক্ত করে রেখেছেন,আপনাকে নিয়ে কোনো লেখালেখি বা গবেষণা কিছু হয়েছে? একটু জানান...

➤ যুগে যুগে সেই কাজগুলোই মানুষ মনে রাখে,যদি রাজধর্ম তাকে স্বীকৃতি দেয়, তবেই।নতুবা নয়।যে এলাকায় যারা রাজত্ব করে,তারাই যদি বাধা দেয়,তার ব্যপ্তি ঘটে না।আমি কিন্তু তার শিকার, সেই বাম আমল থেকেই।
তবে লেখালেখি হয়েছে অনেক পত্র পত্রিকায়,যেমন আনন্দবাজার, আজকাল,সানন্দা, দি এক্সপ্রেস নিউজ নামে এক ইংরেজি দৈনিকে,এছাড়াও সাপ্তাহিক পত্রপত্রিকায়। এছাড়া টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে,অনলাইন পত্রিকাতেও লেখালেখি হয়েছে। এছাড়াও প্রদীপ কর তার সমাকৃিতি পত্রিকায় আমার কাজ নিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল।পরবর্তীতে সেটি একটি বই হিসাবে প্রকাশও করে প্রদীপ। এছাড়া প্রদীপের তৎপরতায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনদিনের একটি প্রদর্শনী হয় ২০০৭ সালে এবং বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের তরফ থেকে সেই মঞ্চেই সম্মাননা দেয়া হয়।

এই কাজ নিয়ে কে গবেষণা করবে সুব্রত? কাঠ-কুঠ নিয়ে সময় কাটানোর পাগল এক-দুটিই থাকে।

৭) দাদা আপনি এখন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তারমানে আপনি এখন এই শিল্পের জন্য প্রচুর সময় দিতে পারেন? মানে সারাদিনে কতক্ষণ সময় দিয়ে একটি কাটাম কুটুম কে সম্পূর্ণ রূপে তৈরী করা হয়?

➤ এই কাজগুলো টানা সময় ধরে হয়না।আমিও করিনা। কেননা শেকড়ের সন্ধান পেলে তাকে নিয়ে আসি,রেখে দিই।দিনের পর দিন দেখি,তাতে অবয়ব খুঁজি। কি হতে পারে।তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই।এইভাবেই কয়েকটা কাটাম-কুটুম একসাথে Final করি।

৮) পবন দা,আপনার এই শিল্পের স্মীকৃতি স্বরূপ কোনো সম্মাননা পেয়েছেন? একটু জানান দাদা..

➤ দেখো ভাই( সুব্রত), যারা কাজ করে, কে কখন সম্মান জানাবে তার আশা নিয়ে কাজ করে না।তাদের নেশা থেকেই করে।পরে পেশাতে পরিনত হয়।আমি তারও ব্যতিক্রম। আমি তো শুধু নেশাতেই রেখেছি ভাই (হেসে), পেশা করিনি।তবে হ্যাঁ অন্যরা করুক এটা আমি চাই।
তবে সম্মান, প্রশংসা আশা করি। পছন্দও করি।বিষ্ণুপুর সাহাপাড়া নেতাজী যুবক সংঘ ২০১৫ সালে সম্মান জানিয়েছে,এই পর্যন্তই। আমি খুশি।

ধন্যবাদ পবন দা। আপনাকে আমাদের মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা এবং  সকল পাঠককুলের পক্ষ থেকে অসংখ্য ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। আমি,সুব্রত পণ্ডিত, আমার তরফ থেকে আপনাকে আগাম শারদ শুভেচ্ছা।ভালো থাকবেন দাদা।এভাবেই আনন্দে থাকবেন।

ধন্যবাদ তোমাকে আর অভিজিৎ কেও।তোমরাও ভালো থেকো,সাহিত্যে থেকো।মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা ও এগিয়ে চলুক। এই প্রার্থনা করি।


No comments:

Post a Comment