মাটির কাছাকাছি
তখন বস্তার জেলার কোন্ডাগাঁও থাকতাম। আদিবাসী বহুল এলাকা ছিল সেটা। সে সময় আদিবাসীরা আরও সহজ সরল ছিল। বাইরের সভ্যতার সঙ্গে তখনও তাদের তেমন পরিচয় হয়নি।
সেই সময়কার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছিল। কোন্ডাগাঁয়ে তখন সবে সবে তৈরি হয়েছিল একটা সিনেমা ঘর। তখনও সেই সিনেমার পাকা ছাদ পড়েনি। ছাদের বদলে মাথার ওপরে থাকতো বড় এক তাবুর আচ্ছাদন। আমরাও নির্দ্বিধায় যেতাম সিনেমা দেখতে। সে দিনও গেলাম সিনেমায়, মা-বাবার সঙ্গে ছিলেন। একটা ধার্মিক বই চলছিল, আমার যতদূর মনে পড়ে, হর হর মহাদেব, বইটার নাম ছিল। খুব ভিড় ছিল সেদিন। কোন্ডাগাঁর মত দেহাতি জাগায় এই ধরনের পিকচারে ভিড় হবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। পর্দার খুব কাছাকাছি বসতে হয়েছিল আমাদের। সিনেমা হলের মধ্যে লক্ষ্য করলাম, অনেক আদিবাসী লোক সপরিবারে সিনেমা দেখতে এসেছে। হ্যাঁ আসতেই পারে, মহাদেব ভোলা মহেশ্বরকে ভারতবর্ষের কে না চেনে !
আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেই ছবির বিশেষ দৃশ্যগুলির কথা। ছবিতে তখন মহাদেবের আরতী চলছে, ভক্ত দল মহাদেবের জয়গান করছেন। তাঁদের মুখের ‘হর হর মহাদেব’ জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, ঠিক এমনি সময় আমাদের কানে ঠুং ঠাং শব্দ এসে বাজতে লাগলো। আমরা শুরুতে কিছুই বুঝতে পারলাম না। তারপর ব্যাপারটা বোধগম্য হল, আদিবাসী লোকরা দক্ষিণা দেবার মত মহাদেবের উদ্দেশ্যে পয়সা ছুড়ে মারছে। শুরুতে সিনেমার পর্দার কাছে কিছু পয়সা পড়ার পর, শুরু হল মহাদেবকে উদ্দেশ্য করে পয়সার বৃষ্টি। এমনিভাবে অনেক পয়সা নিবেদিত হল মহাদেবের পদতলে মানে সিনেমার পর্দার কাছে। আমরা সবাই আন্দাজ করতাম, এই সব পয়সা সিনেমা হলের মালিক ও কর্মচারীর ভোগে লাগবে।
সে দিন আমরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম। মনে পড়ে, অপরিপক্ক দেহাতি বুদ্ধিহীন আদিবাসীদের নিয়ে অনেক ঠাট্টা-তামাশা করেছিলাম। আর শুধু সে দিনই বা কেন--এই প্রসঙ্গটা নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে খুব হাসাহাসি করতাম, জীবনের অনেকটা সময় এ ঘটনা আমাদের মনে হাসি তামাশার খুরাগ জুগিয়েছে। পরবর্তী সময়ে যেখানে যেখানে বদলি হয়েছি, সব জাগায় এ ঘটনা বড় মুখরোচক ও তামাশা বিনোদনেই ব্যাপার হয়ে উঠে ছিল।
আজ কিন্তু এই পরিণত বয়সে সে ভাবনাকে আর নিছক হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারি না। মাঝে মাঝে ভাবলে নিজে নিজেই আশ্চর্য হই, মনে হয় আমরাও তো মাটির মূর্তিকে মানে এক পুতুলকেই পূজা করি, আরাধনা করি, তাকে নিবেদন করি ভক্তি আর ভক্তির সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণার পয়সা ধাতুর পাত্রে ছুঁড়ে দিই, আর তা থেকেও ঠুং ঠাং শব্দ ঝংকৃত হয়ে উঠে আসে। আমরাও তো নিজের ঘরের আসনে ফটো রেখে পূজা করি। তা হলে ? সিনেমার পর্দার ছবি আর আমাদের ঘরের পূজিত ছবির মধ্যে আসলে তো বিশেষ কিছুরই পার্থক্য নেই। প্রকৃতপক্ষে সময় পরিবেশ ও পরিস্থিতি আমাদের অনেক কিছু বুঝিয়ে দিতে পারে। আমরা জীবনের একটা সময় সত্যিটাকে অবশ্যই বুঝে উঠতে পারি যে সরল মাটির কাছাকাছি থাকা সে দিনের সেই আদিবাসীদের নিবেদিত দক্ষিণা সত্যিই ঠাকুর গ্রহণ করতে পারেন। সে দিনের আদিবাসী আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য ছিল এই যে আমরা নিজেদেরকে অনেক মেকি বানিয়ে ফেলেছি--প্রকৃতি থেকে আমরা অনেক দূরে কৃত্তিমতার দিকে এগিয়ে গেছি।
No comments:
Post a Comment