Friday 15 October 2021

শারদীয় সংখ্যা ~গল্পে অমিত সরকার

|| মল্ল সাহিত্য ই-পত্রিকা || শারদীয় সংখ্যা|| গল্পে অমিত সরকার



প্রজাপতি, ট্রেনের গভীরে


তারপর অন্ধকারের মধ্যে রঙ আসে, শরীরে ফুটে ওঠে অচেনা বর্ণমালা। চওড়া হাইওয়ের মত রঙের ব্যান্ড তাকিয়ে থাকে তার দিকে। আলো তার থেকে খানিকটা দগদগে লাল তুলে নেয়, লাল না সিয়ান ? গড়িয়ে দেয়। কাশঝোপের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর মতো গড়িয়ে পড়ছে রঙ। সে নিখুঁত সূর্যাস্তের মত একটা টিপ আঁকে অনেক যত্নে। তার ওপরে দুটি বাঁকা তিরের মত সমান্তরাল। পয়োস্তি মাটিরঙা কপাল পেরোতে পেরোতে ঘোমটার সীমান্তলাইন। সেজে উঠছে অচেনা শরীর। কালচে লাল গড়াচ্ছে সিঁথি বেয়ে। আহ, উরু বেয়েও একদিন…। তার শরীর মুচড়ে ওঠে। সে যেন এই অচেনা হায়রোগ্লিফকে পড়ি পড়ি করেও পড়ে উঠতে পারে না। অথচ ইস্কুলে পড়ার সময় সবাই বলতো সে খুব ভালো ছবি আঁকে। বোবা যন্ত্রণায় শরীর নিজেকেই আঁচড়ায়, কামড়ায়, রক্তাক্ত হয়। তবু ঠিক পড়ে উঠতে পারে না…।
        ‘এই বোকাচোদা। আবার ঘুমের মধ্যে দেয়ালা করছিস ? ঠিক করে শো, চুদির ভাই।’ সপাট লাথিটা আছড়ে পড়ে পাছার একটু ওপরে। ঘুম আর জাগরণের মধ্যবর্তী সীমান্তলাইনে কারা যেন বেয়োনেট উঁচিয়ে বলে ‘হল্ট, হ্যান্ডস আপ।’সে কুঁকড়ানো চোখ খোলে। ঘরে আধা আলো ফুটছে । সকালে এটাই জরি কারখানা। পাঁচ সাতটা লুঙ্গি পরা দেহ শুয়ে আছে। দড়িতে সারি সারি লাল আর সবুজ গামছা। ঘাম আর খাবারের একটা মিশেল গন্ধ। একদম কোনায় দুজন এই উত্তাপেও চাদরের নীচে। তবু বোঝা যাচ্ছে পরস্পরের লুঙ্গির ভেতরে গলানো তাদের হাতের নড়াচড়া। প্রায় রাত্রে ওর এরকম হয়। এমা, হয় নাকি এরকম কারোর ? ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে এই পুরুষের দেহ। শরীর ধার চায় অন্যরকম শরীর। ও নিজের লিঙ্গ হাত দিয়ে চেপে ধরল। সটান শক্ত খাড়া হয়ে আছে, তারপর তীব্র আশ্লেষে খেঁচতে শুরু করলো। যেন শরীর থেকে এখুনি ছুঁড়ে ফেলবে এই গোপন ভয়যাপন। যাক, বদরক্ত বেরিয়ে যাক।
‘আলো, মালিক বলেছে কালীপূজো ভাইফোঁটা মিলিয়ে সাতদিন কারখানা বন্ধ রাখবে। ওই দিনগুলোর তো খোরাকীও দেবে না। কী করবি তবে ? আবার বাড়ি যাবি ?’ পটার প্রশ্নটা শুনে হাতে কাজ করতে করতে মুখ তুলে তাকাল আলো। তার চোখেও চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। এত খরচ করে সদ্য পুজোর পর বাড়ি থেকে ফিরেছে। আবার যেতে আসতে তিন দিন। হাতে পয়সাও তেমন নেই। মাত্র সাতশো টাকা পড়ে আছে। বাড়িতে গেলে বোন, মা, বাবা ভাবে সে সংসারের বেলুনে সাময়িক খানিকটা সুখের হাওয়া পুরে দেবে। সেও তো দিতেই চায়। কিন্তু পাণ্ডেজীর কাছে আগের আড়াই হাজারের ধার এখনো পুরো শোধ হয় নি। শোধ না হলে আর পাওয়া যাবে না।

    কিন্তু… ? নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মত কথারও প্রতিক্রিয়া থাকে, সমান উল্লাসে রবারের বলের মত পটার প্রশ্নটা তার বুকের ভেতর ড্রপ খেতে থাকে, খেতেই থাকে। ক্রমশ বলটার পরিধি বড় হয়। বলের ওপর নাক, কান, চোখ, মুখ গজায়। বলটা হাঁ করে গিলে নিতে চায় আলোকে। তারপর আস্তে আস্তে বলটা গোল চাকতির মত হয়ে যায়। একটা মুখ, সুন্দর পুরুষালী মুখ। ফর্সা, ঝকঝকে জিনস আর পাঞ্জাবী পরা। আকর্ষ দিয়ে তাকে টানছে। না, না, তাকে নয় অন্য একটা মেয়েকে। একটা মেয়ে, গমরঙা মেয়ে। সে তাদের বাড়িতেই থাকে, তার সঙ্গে। দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে লুকিয়ে শাড়ি পরে আয়নায় নিজেকে দেখে। মেয়েটা ছোটবেলায় দিদিদের সাজের জিনিস চুরি করে লুকিয়ে একা একা সাজত। সেই মেয়েটার একটা লুকোনো বাক্স ছিল। শক্তপোক্ত জুতোর বাক্স। তার মধ্যে থাকত চুরি করা টিপের পাতা, অনেকটা খালি হয়ে যাওয়া নেলপালিশ। তাদের বাড়ির কেউ কিন্তু চিনত না মেয়েটাকে। শুধু সে ছাড়া।
‘এই খানকির ছেলে, লাইন সরে যাচ্ছে কেন। ঘুমোতে ঘুমোতে সেলাই করছিস নাকি ? খুলে আবার কর।’
সুপারভাইজারের খিস্তিটা বুলেটের মত কানে ঢুকে যায়। জয়ন্ত তাদের সঙ্গেই জরি সেলাইয়ের কাজ করে। বয়েস ও অভিজ্ঞতা দুইই অনেক বেশী বলে মালিক ওকে সুপারভাইজার করেছে। সে বাস্তবে ফেরে, বোঝে আঘাতই আসলে শরীর চেতনার প্রকৃত উদযাপন। আঘাতই ট্যাবলেট হয়ে বুঝিয়ে দেয় কেউ নও, তুমি কেউ নও, আসলে শুধুই একটা শরীরী যাপন মাত্র। আলো হেসে কথাটা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে। ‘শালা হারামী, আবার মাগীদের মত মুখ মচকে মচকে হাসছে। ঠিক করে কাজ কর। গত মাসে তোর হাতের দুটো এক্সপোর্টের মাল রিজেক্ট হয়েছে। মালিক বহুত খচে ছিল। আমি অনেক বলে ঠাণ্ডা করেছি। আবার হলে কিন্তু তনখা থেকে কেটে উসুল করবে।’

2

‘জয়ন্তদা, বলো না, মালিক কী কালীপুজোয় কারখানা বন্ধ রাখবে ? তখন আমাদের তাহলে কী হবে ?’
‘তাই তো শুনেছি রে। এবছর নাকি মার্কেটের হাল খুব খারাপ। মোদী শালা জি-এস-টি না মিএসটি কী সব
লাগিয়ে মালিকের ব্যবসার পোঁদ মেরে দিয়েছে। বেশী প্রোডাকশন করে আর লাভ নেই। তাই দিওয়ালীতে টানা সাতদিন ছুটি।’ ‘আমাদের কী এখানে থাকতেও দেবে না ?’ ‘দেখছি, সেটা আমি বলবো মালিককে। বলবো, আমরা কারখানাতেই যেমন থাকি থাকব। সব দেখেশুনে রাখব। তোদের ছুটি ওই টাইমে। শালা, সবাই মিলে ঘুরবো, ফিরবো, মাল খাব। চৌপাট্টিতে গিয়ে মস্তি করবো।’ ‘মস্তি করতে এথি লাগে বস। পুজোর পর থেকে তো হাত পুরো ফাঁকা। শালা মালিকও এমন ঢ্যামনা, যে আর অ্যাডভান্স দেবে না।’ পটা সেলাই করতে করতে মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। ‘হ্যাঁ, পয়সা তো আকাশ থেকে পড়ে, যে তোর গাঁড়ে রোজ অ্যাডভান্স ভরবে। আর তুই আর একটু কাজে মন দে আলো। কী সব এত ভাবিস দিনরাত ? একবার জরি কারখানা থেকে বার করে দিলে, ভিখ মাঙা
ছাড়া কিন্তু আর উপায় থাকবে না। আর তুই মেয়েছেলেও নোস যে মারিয়ে ভাত জোটাবি।’ সুপারভাইজার জয়ন্ত কথাটা আলোর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে নিজের কাজে আবার মন দেয়। আলোর মনের ভেতরটা এই উল্লেখে আবার রিনরিন করে ওঠে। এমা ছিঃ, মেয়ে হলেই যেন …? মানুষের একটা নিজের পছন্দ অপছন্দ থাকতে নেই। সেই ছোটবেলা থেকে মধুকাকা যখন তাকে জড়িয়ে ধরত, গুঁফো মুখ নিয়ে চুমু খেত, খইনির গন্ধে তার গা টা কেমন গুলিয়ে উঠত। মধুকাকা জোর করে তার হাতে নিজের শক্ত বাঁড়াটা ধরিয়ে দিত, হালকা করে নাড়াতে বলতো, ওখানে চুমু খেতে বলতো। কয়েকবার জোর করে চুষিয়েওছিল। গা টা ঘিন ঘিন করে উঠত আলোর। কিন্তু অর্জুনদা যখন তাকে আদর করলো ওর তো এরকম হল না। এই তো সেদিন, অর্জুনদা প্রথম যখন ওকে আদর করেছিল, কোথাও যেন একটা সুইচ অন হয়ে গিয়েছিল আলোর। সারা শরীর কীরকম শিউরে উঠেছিল। অর্জুনদার জামায়, শরীরে কি সুন্দর একটা গন্ধ। স্কিনটা কি সুন্দর, মাখন মাখন। আলো ডোমজুড়ে এরকম স্কিন কারোর দ্যাখেনি। এতোটা সুন্দরও একসঙ্গে কখনো দেখেনি। মানুষ হয়তো খুব অসময়েই একমাত্র সুন্দরকে দেখতে পায়। আলো ভাবতে ভাবতে আবার ছুঁচে সুতো পরায়। অর্জুন সেদিন বাবার কারখানায় এসেছিল কি একটা কাজে। ওর বাবা ওকে বলেছিল গাড়িতে করে একটা মালের পেটি নিয়ে গিয়ে বাড়িতে রাখতে। আর আলোকে বলেছিল ওর সঙ্গে যেতে পেটিটা গাড়িতে তুলে দেবার, নামানোর জন্যে। আলোর সেই প্রথম মালিকের বাড়িতে আসা। বাড়িটা কী সুন্দর, ঠিক সিনেমার বাড়ি যেন। আর অর্জুনদার ঘরটা কী যে ঠাণ্ডা। কী সুন্দর একটা গন্ধ। আলোর চোখে একমুহূর্তে ঘরটা ফুটে ওঠে, সিঁড়িটাও। আসলে সিঁড়িটাই তো সব। সিঁড়িটাই তো পালটে দিয়েছিল দিনটাকে। সিঁড়িরাই তো পালটে দেয়। সবাই তো একটা সিঁড়ি খোঁজে। ওর স্বপ্নের ভেতরেও মাঝে মাঝে সিঁড়িটা ফুটে ওঠে। সাদা মার্বেলের মধ্যে হলুদ সিঁড়ি। ওর স্বপ্নের মত হলুদ। সিঁড়ি মানে সেদিন ওর কাছে মাল তুলতে তুলতে একটা আচমকা হোঁচট। আর অর্জুনদার প্রায় কোলে চেপে ওর ঘরে। কেমন যেন একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল সেদিন। অর্জুনদার সব কিছুই কেমন অচেনা, কি সুন্দর। অর্জুনদা ওকে বসিয়ে ওর পায়ে নিজের হাতে একটা ঠাণ্ডা ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিল। কেমন একটা লেবু লেবু গন্ধ উঠে আসছিল চাদর থেকে। আর তারপরই, আহ …। সেদিনের কথা ভাবলেই আলোর শরীরটা শিউরে ওঠে, জ্বলে ওঠে সেই সুইচটা। ছোটবেলার সেই গোপন মেয়েটা ওর ভেতরে ফিরে আসে। মেয়েটার স্বপ্নগুলো ফিরে আসে। আলো মেয়েটার থেকে সরে যেতে চেষ্টা করে। ওর আঙুলে ছুঁচ ফুটে গেছে।
    দিওয়ালীর ছুটি পড়ে গেছে কারখানায়। গোটা শহরটা ক্রমশ আলোতে সেজে উঠছে। যেন স্বপ্নের শহর।
মালিককে ম্যানেজ করে জয়ন্ত ওদের থাকার ব্যবস্থা করতে পেরেছে। রোজকার খোরাকী যেটা মালিক দেয় সেটাও দিচ্ছে। দু’বছরের চাকরি জীবনে এমন নির্ভেজাল টানা ছুটি আলো আগে কখনো পায়নি। সকালে দেরী করে ওঠা, তারপর এর ওর সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে যখন ইচ্ছে চা, বড়া পাও, দুপুরের খাবার, বিকেলে শহরের পথে পথে। এত সুখ, তবু কেন যেন ওর মন ভালো থাকছে না। ওর স্বপ্নের মধ্যে এখন শুধু রাত বড় হয়। রাত চিরে চিরে বেজে ওঠে অচেনা হারমোনিয়াম। মাকড়সারা কুয়াশা বোনে, অগোছালো চাদর পেতে রাখে। যেন সেই চাদরে এইমাত্র শুয়েছিল এক অচেনা গন্ধের তীব্র পুরুষ। আর প্রজাপতিদের ডানা ভিজে যায় কান্নার শ্রাবণে। ও দেখে আলোকিত শাড়িরা উড়ে উড়ে আসছে একের পর এক। ওকে জড়িয়ে ধরছে। জড়িয়ে ধরছে রঙ। রঙ লেগে যাচ্ছে চুলে, সিঁথিতে। ও ক্রমশ একটা তিতলি হয়ে যাচ্ছে। রঙ্গিলা তিতলি, তিতলি না মথ ? ও ক্লাস টুয়েলভ অবধি স্কুলে পড়েছে। পড়েছে মথেদের জন্মবৃত্তান্ত, অভিযোজন। পরিবেশবিজ্ঞানের ক্লাসে একবার স্যার বলেছিলেন, কবে একটা যেন শিল্পবিপ্লব না কিসের পর ইংল্যান্ডে না কোথায় সব প্রজাপতিরা কালো হয়ে গিয়েছিল। ও নিজেকে ওরকম ঝুলকালো মথ ভাবতে চায় না, কিন্তু তিতলিটা কিছুতেই আর পিউপা দশা থেকে বেরোতে পারছে না। জরি কারখানার চকচকে সুতোরা ওকে জড়িয়ে ধরেছে। কিরকম যেন খাঁচার মত। জরিরা যেন সেই খাঁচাটার স্টিলের রড। প্রজাপতিরা কি পারে খাঁচাটাকে মুছে ফেলতে ? ওও পারছে না। এভাবেই রাতটাকে মুছতে মুছতে সকাল। না মোছা সকালের নাম রাত্রি। এভাবেই আবার একদিন অর্জুনদার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সিটি লাইনের ষ্টেশনের পাশে। অর্জুনদা ওকে চিনল, নিজেই ডাকল। সঙ্গে একটা বন্ধু।

3

ছেলেটা একটু কেমন যেন। আলোর ভালো লাগে না ছেলেটাকে। ইচ্ছে করে আজ অর্জুনদা ওকে নিয়ে ঘুরুক। শহুরে যৌবনকে প্রত্যাখ্যান করে সেই মেয়েটার লাবণ্যে ফিরে আসুক। অর্জুন ওকে ডাকে, পায়ের খবর নেয়। ভালো আছে কিনা জিজ্ঞেস করে। রোল কিনে দেয়। খুঁটিয়ে জেনে নেয় সব। তারপর হঠাৎ গলা নামিয়ে বলে, ‘আলো, কাল একবার একা একা আসতে পারবি আমাদের বাড়িতে। চিনতে পারবি না ? এই তো ভিটি থেকে মোটে চারটে ষ্টেশন। ধর, এই তিনটে নাগাদ। কাল বাড়িতে কেউ থাকবে না। দাঁড়া আমি তোর গাড়িভাড়া দিয়ে দিচ্ছি।’ একরকম জোর করেই অর্জুন ওর জামার পকেটে দুহাজার টাকার একটা নোট গুঁজে দেয়, ‘আর শোন। কারখানার কাউকে কিন্তু কিচ্ছু বলবি না, কেউ যেন জানতে না পারে আমি তোকে ডেকেছি, বুঝেছিস তো।’ প্রজাপতিটা লাফ দেয় নীলাভ কাশফুলে। প্রতিটা ফুলের গায়ে একেকটা লাইটহাউস। সন্ধ্যেটা পরির নেকলেস হয়ে ওঠে। পরের দিনটা যেন আসতেই চাইছে না। কে যেন একটু একটু করে নির্মাণ করছে রাত। সেই মেয়েটা আবার ওর একাকীত্বের শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে, ওর একটা ইরেজার চাই। এক্ষুনি রাতটাকে মুছে ফেলা চাই। ওর মোবাইল ফোন নেই। আলোর মোবাইল ফোন থাকলে ও অর্জুনদার একটা ছবি তুলে রাখতো। আর, আর অর্জুনদার সঙ্গে একটা সেলফি। এভাবেই খানিকক্ষণ পড়ে ফ্যাকাশে প্লেটে ওমলেট হয়ে সূর্য ওঠে। আলো ওঠে। সস্তার হাতঘড়ি বারবার ওকে আজ বিভ্রান্ত করছে। বুকের ভেতর ডাহুকের স্বর। তিনটে যেন বাজতে চাইছে না। অনেকক্ষণ সন্ধ্যে হয়েছে। এখন সিটি লাইনের একদম ফাঁকা একটা ষ্টেশনের ধারে আলো বসে আছে। দূরে কোথাও মাইকে গান হচ্ছে ‘ডোলি সাজাকে রাখনা, মেহেন্দি লাগাকে রাখনা।’ শুধু অনেকটা বৃষ্টিমেঘ কাটাকুটি খেলছে ওর দুচোখের পাতায়। সামনে রেললাইন পেরিয়ে ঢেউ তুলছে অন্ধকার। পাশেই একটা ছাতিম গাছের গা থেকে উড়ে আসছে নিঃস্পৃহ গন্ধ। মাঝে মাঝে এক একটা ট্রেন না থেমে খুব দ্রুত…। ও তো আজ শুধু একা অর্জুনদাকেই চেয়েছিল। ও তো আর কারুর সঙ্গে সমুদ্রে নামতে চায় নি, চায় নি হেঁটে যেতে জলের কিনারা ধরে। চায় নি পুড়ে যাক ওর ব্যক্তিগত বাঁশিগুলো। ওর স্বপ্নের মধ্যে সেই মেয়েটার মুখের ওপর দিয়ে ঢাকা সাদা চাদর। তার ওপরে একটা গোল ফুলের মালা, সাদা। ধুপের ধোঁয়ারা মেঘেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে। মেয়েটা একদম সত্যিকারের মরে গেল। মেয়েটা এখনো ওর ভীষণ ভীষণ প্রিয়। ছোট থেকেই মেয়েটা ওর স্বপ্নে। রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন অন্য দিদিরা যখন মঞ্চে উঠে লাল পাড় শাদা শাড়িতে, নাচে গানে। সেই মেয়েটাও কিন্তু মনে মনে ওদের সঙ্গে “পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে…”। দিদিদের শাড়ি, নরম কচি কমলালেবুর মত বুক দেখে সেই মেয়েটাও ওইরকম একটা শরীর চাইতো। অমন ভ্রূভঙ্গি চাইতো, লাস্য চাইতো। সে চাইতো না আলোর দাড়ি গোঁফ উঠুক। ওখানে নরম চুল গজাক। আলো দু পায়ের ফাঁকে নিজের লিঙ্গটা লুকিয়ে রাখলে মেয়েটা খুশি হত। যেন ওখানে নিখুঁত একটা ত্রিভুজ থাকা উচিত। একলা ঘরে আলো মেয়েটাকে খুশী করার চেষ্টা করতো। ক্লাস ফোরে একবার ওর ব্যগে বন্ধুরা আবিষ্কার করেছিল একটা ছোট আয়না আর আধখালি নেলপালিশের শিশি। সবাই এমন করে ওকে টানাটানি করেছিল যে আলো কেঁদে ফেলে। সেদিন ওকে বাঁচিয়েছিল দুবার ফেল করা সুরঞ্জন। ছুটির পর সবাই চলে গেলে সুরঞ্জন ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। ফেরার সময় ফাঁকা একটা ঝোপের ধারে ওকে সুরঞ্জন চুমু খেয়েছিল। না, না, ওকে নয়, সেই মেয়েটাকে। সেই রাতে স্বপ্নে মেয়েটা সুরঞ্জনের বউ হয়ে গিয়েছিল। শক্তপোক্ত পুরুষালী সুরঞ্জনের আঁচল জড়ানো সোহাগ করা বউ। কিন্তু তারপর থেকে আর কোনদিন সুরঞ্জন ওর সঙ্গে মেশে নি। ওর দিকে তাকাতোই না। ঠাকুমার কাছে রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে মেয়েটা একলা একলাই রাজকুমারী হয়ে যেত। আর সুরঞ্জন পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্তুর। তারপর আবার ফেল করে সুরঞ্জনের ক্লাস আলাদা হয়ে গেল। কেন যে মেয়েটা যাকেই ভালবাসে সে এমন করে দূরে সরে যায়। আজও তো ঠিক তেমনিই হলো। আলো অর্জুনের বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিল একদম ঠিক সময়েই। তারপর অর্জুনকে আদরে আদরে ফুটিয়ে তুলেছিল, যেন হাতের পাতায় ফুটে ওঠা একটা রক্তকরবী। যেভাবে যেভাবে অর্জুন চেয়েছিল, ঠিক সেভাবেই। খুব লাগছিল ওর। অল্প রক্তও ব্বেরিয়েছিল। তবু ও একদম কষ্ট পায় নি। অর্জুনদা যে নিজে হাতে করে ক্রিম লাগিয়ে দিয়েছিল ওর শরীরে। সুখে আলোর শরীরটা শিউরে শিউরে উঠছিল বার বার। কেন যেন তারপরেই অর্জুনদা ওর দুজন বন্ধুকে ফোন করে ডেকে আনল। একজন তো সেদিনের সেই ছেলেটা। ও তো আর কাউকে নিতে চায়নি। তবু ওরা জোর করে ওকে…। ওর মুখে ঢুকিয়ে…। ও বলেছিল, ‘তোমার পায়ে পড়ি অর্জুনদা আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আর নিতে পারছি না।’ অর্জুন বলে উঠেছিল, ‘চুপ করে থাক। তোকে দুহাজার দিয়েছি তো। আরও তিন হাজার দেব। আমাকে যেমন চুষে দিলি, আমার বন্ধুদেরও ওরকম দে। ওদেরকেও খুশী কর।’ ওরা নিজেরা খুব দ্রুত ইংরাজিতে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করছিল। ও শুধু একটা কথাই বুঝতে পারছিল, ’সেফ, সেফ। প্রফেশনাল নয়।’ ট্যাটু করা একজনেরটা আবার ভীষণ বড়। খুব লেগেছে আজ আলোর। আসার সময় ওর পকেটে ওরা অনেকগুলো টাকা গুঁজে দিয়েছিল, অনেক বেশী টাকা। আলো অবশ্য গুনেও দেখে নি। শুধু অর্জুনদার কথা শুনে হাজার কষ্ট হলেও ওরা যেমন যেমন বলেছে তেমনি তেমনি করে গেছে। তবু ও যখন বেরিয়ে আসছে, সেই ছেলেটা মজা করে ওকে লাথি মারল, ওর চুল ধরে অকারণে ওকে একটা থাপ্পড় মারল। তারপর এটাই একটা খেলা হয়ে গেল। ওরা সবাই ওকে

4

মারল, লাথালো, এমনকি অর্জুনদাও । যেন ও একটা ঘেয়ো কুকুর, যাকে যখন ইচ্ছে পেটানো যায়। আর, আর অর্জুনদাও অন্যদের সঙ্গে তখন হাসিতে ফেটে পড়ছিল, বন্ধুদের সঙ্গেই। বাড়ির কাছেই ষ্টেশন। আলো বেরিয়ে এসে একটা ট্রেনে চেপে বসল। পরপর চলে যাচ্ছে যেদিকে দুচোখ যায় এমন সব ট্রেন। তারপর একা এখন এই নির্জন ষ্টেশনটার সিঁড়িতে। মেয়েটা ওর বুকের মধ্যে একা বসে বসে কাঁদছিল। হয়তো মেয়েটা ভেবেছিল, রাস্তা থেকে একদিন কুড়িয়ে পাবে নিজে নিজে বেজে ওঠা একটা মাউথ অর্গান। একটা পাখির পালকে একদিন হয়তো দুধে ধোয়া জোনাকিরা বৃষ্টি হয়ে টুপটুপ করে ঝরে পড়বে। পিউপার ভিজে বুকের ভেতর একটা ঘোরান সিঁড়ি ধরে উঠে যাবে সে আর তার রাজপুত্তুর। মেয়েটা জানতো না, আসলে স্বপ্নের আড়ালে প্রত্যেক চোখেই একটা সমুদ্র লেখা থাকে। প্রজাপতিরা কিন্তু সেটা পেরোতে পারে না। লাল কাঁকড়ার সঙ্গমের মত গোপন, আলোহীন, তিনশো কিলোমিটার চিঠির মত দীর্ঘ সমুদ্র। তারা বারবার ভুল ট্রেনে চড়ে বসে আর সমস্ত ভুল ট্রেন এসে ডুবে যায় সেই অথৈ-য়ে। মেয়েটা এখন উঠে দাঁড়াচ্ছে। সিঁড়ি ভেঙে এগিয়ে আসছে লাইনের ধারে। দূরে ট্রেন আসছে, এবং ট্রেনটা এখানে থামবে না।


No comments:

Post a Comment