লুকোচুরি খেলা
আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা।
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই-- লুকোচুরি খেলা॥
এই মাঠ, ঘাস, সাঁঝবেলা। চরাচর শান্ত হয়ে আসার বেলা। আলো আঁধারি। তাতে লুকোচুরি খেলা।
খড়ের পালুই, ঝোঁপ-জঙ্গল, পোড়ো বাড়ির মতো জায়গায় নিজেকে লুকিয়ে ফেলে চলত খেলা। আর আড়াল থেকে শোনা যেত ‘কুক’! ধরা পড়লেই - ‘ধাপ্পা!’।
নিয়ম হল, মোড়ধারী এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এক থেকে একশো পর্যন্ত গণনা করবে। আর ওই সময়ের মধ্যে বাকি খেলোয়াড়দের খড়ের গাদা, ঝোঁপ-জঙ্গল বা পোড়ো বাড়ির আড়ালে আলাদা আলাদা ভাবে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে হবে।
একশো গোনা হয়ে গেলে চোর ধরার পালা। লুকনো জায়গা থেকে ভেসে আসে ‘কুক’ শব্দ। সেই শুনে খেলোয়াড়দের খুঁজে বের করার পালা মোড়ধারীর। সবার আগে যাকে মোড়ধারী খুঁজে পাবে তার নাম-সহ ‘আইস-বাইশ’ বলে চিৎকার করে উঠবে। এরপর একে একে অন্যদের খুঁজে বের করতে হবে মোড়ধারীকে। সবাইকে খুঁজে বের করতে পারলেই মোড় ঘোচে মোড়ধারীর। তখন ‘আইস-বাইশ’ চিহ্নিত খেলোয়াড়কে মোড় খাটতে হয়।
কিন্তু প্রথমজনের পর অন্যদের খোঁজার সময় যদি কোনও খেলোয়াড় মোড়ধারীর নজর এড়িয়ে তার পিঠে চাপড় মেরে ‘ধাপ্পা’ বলে চিৎকার উঠতে পারে, তাহলে আর মোড় ঘোচে না মোড়ধারীর। সেক্ষেত্রে প্রথম খুঁজে পাওয়া খেলোয়াড়ও খেলায় সামিল হওয়ার সুযোগ পায়। ফের একই প্রক্রিয়ায় মোড় খাটতে হয় মোড়ধারীকে।
এ খেলা ভাঙতেই চাইত না। বাড়ি থেকে মা কান ধরে টেনে না নিয়ে গেলে। সেই খেলাটাই হঠাৎ কোথায় গায়েব হয়ে গেল। ভূবনে এমন মোড়ধারী নেই যে খুঁজে বের করে।
ছোটবেলায় খবরের কাগজে লুকোচুরি খেলার ওস্তাদের খবর হতো হেডলাইন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়তাম। সাতের দশকের শেষ থেকে আটের দশক জুড়ে। স্কুলজীবনে। তখন তিনি এক রূপকথার নায়ক। খলনায়কও বটে। ওই সময়ের হিন্দী ছবির উগ্র খলনায়কদের থেকে আলাদা। অ্যান্টি হিরো। অজস্র গপ্পোগুজবের খোরাক।
লোকটার ৩০টা গার্লফ্রেন্ড। ১৪টা ভাষা গড়গড় করে কথা বলে যেতে পারে। চোখের দিকে তাকালে তাবড় সুন্দরীরা ভূপতিত! খুন করে পাসপোর্ট হাতিয়ে নেয় তাদের। জেল থেকে পালায় কেত মেরে। ‘বিকিনি কিলার’, ‘দ্য সারপেন্ট’ ইত্যাদি খেতাব জুটে যায় এসবের মাঝেই। খবরের কাগজের ফ্রন্ট পেজে নিজের ছবি দেখে অপছন্দ হলে বলেন- ‘আই ডোন্ট লাইক দিস পিকচার। সেন্ড দেম আ গুড ওয়ান’!
তখনও হলিউডি সিরিয়াল কিলার-এর গল্পের আমদানিন হয়নি এদেশে। আমাদের ছোটবেলার ব্যাড বয় ছিল চার্লস শোভরাজ। আদি। অকৃত্রিম।
নেপালের ধনী পরিবারের মেয়ে নিহিতাকে বিয়ে করেছিলেন চার্লস। সংসার ভেঙ্গে যায় দাম্পত্য অশান্তিতে। এরপর তিনি পশ্চিমা নারীদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে আর্থিকভাবে লাভবান হতেন এবং একসময় প্রেমিকাকে খুন করে ফেলতেন। ১২ জনের বেশি নারীকে খুন করে সিরিয়াল কিলার হন চার্লস শোভরাজ। খুনের ঘটনাগুলো ঘটেছিল ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত।
আসামীর কাঠগড়ায় বলেছিলেন, ‘আমি গরিব ছিলাম বলে অনেক অপমানিত হয়েছি। কিন্তু দেখতে সুন্দর ছিলাম। আর দর্শনশাস্ত্র ও মনোবিদ্যা বেশি করে পড়েছিলাম। ফলে নারীর মন বুঝতে সাইকো-এনালাইসিস করতাম। আর দর্শনের ‘নিহিলিজম’ আমাকে অপরাধ করতে বাধা দিতো না।
তার জীবনীকার ডেভিড রবিনসন। শোভরাজের জীবনী নিয়ে ছবি হয়েছে। ২০১৫ সালে রনদীপ হুডা অভিনীত প্রবাল রমনের হিন্দী ছবি ‘ম্যাঁয় আউর চার্লস।’
শোভরাজের জন্ম ১৯৪৪ সালের ৬ এপ্রিল ভিয়েতনামে। কিন্তু ফ্রান্স ও ভারতসহ আরো কয়েকটি দেশের নাগরিকত্ব ছিলো তার। বাবা ছিলেন ভারতীয়। মা ভিয়েতনামি। চার্লস শোভরাজ খুন করে একদেশ থেকে অন্য দেশে পালিয়ে বেড়াতেন। লুকোচুরি খেলায় সেরার সেরা। ভারতের তিহার জেল থেকেও পালিয়েছিলেন। আবার জীবনী বইয়ের রয়্যালটি, মুভি রাইটস, ম্যাগাজিনে ইন্টারভিউ তাঁকে করে কোটিপতি। জেলে বসেই।
১০ জুন, ২০১৭ কাঠমাণ্ডুর ‘গঙ্গালাল হার্ট সেন্টার’–এ তার হৃৎপিণ্ডে অস্ত্রোপচার করা হয়। বর্তমানে কাঠমাণ্ডু জেলে যাবজ্জীবন সাজা কাটছে। ঐ সময়, দিন কয়েক আগে জেলের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় সে। ডাক্তারি পরীক্ষায় হৃদযন্ত্রে সমস্যা ধরা পড়ে। ভালভ রিপ্লেসমেন্টের জন্য তার ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হবে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। ফ্রান্সের নাগরিক চার্লস প্যারিসে অস্ত্রোপচার করাতে চেয়েছিল। এই অজুহাতে রেহাই মিলতে পারে বলে ভেবেছিল সে। কিন্তু নেপাল প্রশাসনের অনুমতি মেলেনি। তার শারীরিক অবস্থা খতিয়ে দেখে কাঠমাণ্ডুতেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০২০ তে বয়স হয়েছে ৭৪।
শোভরাজ দেখতে ছিল ভীষণরকম সুদর্শন। তার চেহারায় একটা অন্যরকমের আকর্ষণ ছিল যা অল্পবয়সী তরুণীদের কাছে বেশ মোহনীয় ঠেকতো। অল্প বয়সেই শোভরাজের জীবনে বৃষ্টিধারার মতো নারীর প্রেম এসেছে। সে প্রেমে পড়ছে, তার প্রেমেও পড়ছে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই অল্পবয়সী মেয়েদের প্রথম ভালবাসাগুলো এমন হয় যে, তারা কোনো একটা মোহের বশে ঘোরের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কগুলো করে ফেলে। কিন্তু, ধীরে ধীরে প্রেমের গভীর স্তরে যখন তারা পৌঁছে যায়, তখন তারা এই সম্পর্কের ঘোর থেকে বের হতে পারে না। বরং এই প্রেমবোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে সময়ের সাথে সাথে। সাইকোপ্যাথরা এমনিতে বেশ আকর্ষণীয়, আপনি তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যেতে পারেন খুব সহজে, হতে পারেন তাদের প্রতি দূর্বল। তারা আবেগ দ্বারা সিদ্ধান্ত নেবে, আপনাকে ব্যবহার করবে চূড়ান্ত স্বার্থপর হয়ে, তারপর ফন্দি করবে, বিশ্বাসঘাতকতা করবে। অন্যতম বুদ্ধিমান এবং কমপ্লিট সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিলার ছিল চার্লস।
শোভরাজ একটা সাবজেক্ট। যে সাবজেক্ট নিয়ে অনেকেই এক সময় অনেক গবেষণা করেছিলেন। আর আমরা কচি বয়সে হয়েছিলাম মোহিত। গল্পগাথার নায়ক তখন সে। স্কুলে। খেলার মাঠে।
জানিস, চার্লস শোভরাজ তিহার জেল থেকে পালিয়েছে?
বলিস কি!
শোভরাজের খুনগুলো বেশিরভাগই হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। ফলে সেসব দেশের আইন অনুযায়ী তার নামে অনেক খুনের মামলা হয়েছে। রয়েছে লোক ঠকানোর মামলাও। কিন্তু, শোভরাজ জেলের ভাত খাওয়ার জন্য বেছে নেয় ভারতকে। কারণ, ভারতে সে সাজাপ্রাপ্ত হয় চুরির অভিযোগে! ১৯৭৬ সালের কথা সেটা। তার জেল হয় ১২ বছরের।
১৯৮৫ সালের তার সাজা যখন শেষের দিকে, আর অল্প কয়দিন বাকি সেসময় শোভরাজ সিদ্ধান্ত নিলো, জেল থেকে পালাবে। পাগলামি মনে হচ্ছে না? যে কয়দিন পর এমনিই জেল থেকে ছাড়া পাবে সে কেন আবার জেল পালানোর চেষ্টা করছে!
শোভরাজ তার শাস্তির দশ বছরের দিনে একটা বিশাল পার্টির আয়োজন করলো জেলের প্রহরী আর জেলে থাকা আশেপাশের অন্যান্য আসামীদের জন্যে। পান বিভিন্ন উপহার উপটৌকন। ওদিকে সাগরেদরা ব্যবস্থা করেছে ঘুমের ট্যাবলেট আর অজ্ঞান করে দেওয়ার ড্রাগস। পার্টির খাবারে মিশিয়ে দেওয়া হলো। এবং তারপর জেল থেকে নিজে এমনভাবে হেঁটে বের হলো যেন কিছুই হয়নি।
কিন্তু যে ধূর্ত এক খুনি, যে কোনও প্রমাণ রাখে না, সেই জেল ভাঙ্গা কয়েদি খুব সহজেই ধরা দিল গোয়ায় একটা বীচ পার্টি থেকে। সবাই অবাক। আবার সাজা হয় তাঁর। আবার জেলবন্দি। আবার দশ বছর। কিন্তু এটাই তো চেয়েছিলেন তিনি। থাইল্যান্ডে খুনের আসামীর জন্য ওয়ারেন্টের মেয়াদ থাকে কুড়ি বছর। দশ বছরে শোভরাজ ছাড়া পেলে, তাঁকে ভারত সরকার থাইল্যান্ডের হাতে তুলে দিত। সেখানে খুনের মামলাগুলোয় মৃত্যদন্ড অবশ্যম্ভাবী। মোড়ধারী নিজেকেই দিলেন ‘ধাপ্পা!’
১৯৯৭ সালে মুক্তি পান শোভরাজ। চলে যান প্যারিসে। দিব্যি কাটাচ্ছিলেন জীবন। ইন্টারভিউ দিয়ে। ২০০৩এ নেপালে এসে কাঠমান্ডুর রাস্তায় ধরা পড়ে যান। ১৯৭৫এ দুটি খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়। সেই ইস্তক সেখানেই। লুকোচুরি খেলা কি ছেড়েই দিলেন ওস্তাদ?
No comments:
Post a Comment