চির নবীন চির প্রণম্য
এক বিস্তীর্ণ ছায়াপথ চোখের জানালায় দেখতে পাই। সেই ছায়াপথের ধারে কোথাও রয়েছে পয়েন্ট ম্যানের একটা ভাঙা কেবিন। এই ছায়াপথে চলাচল করেন সেইসব মানুষ যারা আজ অতীত। এক অদৃশ্য পয়েন্টম্যান পতাকা উড়িয়ে ছায়াপথের যাত্রীদের নেভিগেট করে ।
একদিন দেখলাম রবীন্দ্রনাথ -"আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি.." স্বকন্ঠে আবৃত্তি করতে করতে ছায়াপথ ধরে হাঁটছেন। পয়েন্টম্যান সবুজ পতাকা দুলিয়ে কবিকে স্বাগত জানাল ।কবি হাঁটতে হাঁটতে ছায়াপথ পেরিয়ে অগোচরে চলে গেলেন।
এরকম ভাবেই দেখলাম জীবনানন্দ, মায়াকভস্কি, রিলখে, লোরকা, ভ্যান গ্য, কাফকা,সিলভিয়া প্লাথ, নিৎসে, ফুকো,সার্ত, ক্যামু দারিদাদের ।
একদিন খুব সকালে দেখি এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক সাইকেলে চালিয়ে যাচ্ছেন । কাছে আসতেই বুঝলাম -আমার বাবা । "বাবা এই সাত সকালে সাইকেলে কোথায় যাচ্ছ ?" আমার প্রশ্নে কোন সাড়া না দিয়ে বাবা ছায়াপথ ধরে এগিয়ে গেলেন। অদৃশ্য পয়েন্টম্যান দেখি একটা ছোট গামলা ভর্তি রাতের তারা বাবার মাথায় উপুড় করে দিল। বাবার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই । তিনি ছায়াপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন নিজস্ব লক্ষ্যে ।
আরো একদিন দেখি বেঁটে খাটো চেহারার প্রিয় বন্ধু কালিদাস সেই টিপিক্যাল হাত দুলিয়ে দুলিয়ে ছায়াপথ ধরে হাঁটছে । আমি ডাকলাম - " কি কালি, কোথায় যাও ?" ও পিছন ফিরে ঘুরে তাকাল। স্বভাবসুলভ পেটেন্ট হাসিটি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বল্ল -" কোথ্থায় আর যাব অভিজিৎ, এই ছায়াপথে ই ঘুরে চলেছি "। আমি বল্লাম - "সেই যে এক বিকেল বেলায় সাইথিয়া রোডের ধারে কালভার্টে বসে বলেছিলে- চল অভিজিৎ কাল খুব ভোরে আমরা নিরুদ্দেশ হয়ে যাই । আমি সেই রাতেই খুব ঘুমিয়েছিলাম আর তুমিও প্রেমে পড়েছিলে "।
তার বহু বছর বাদে আমার প্রিয় বন্ধু নিজের বাড়িতে আত্মমুক্ত হলো নিরুদ্দেশের পথে । ছায়াপথে সেই কালি কে দেখে আমারও খুব ইচ্ছে হল ওর সঙ্গী হবার । কিন্তু উপায় কি, সময় ওর আর আমার মাঝখানে অতীতের লক্ষণরেখা এঁকে দিয়েছে ।
আর আমার হাত ধরে রেখেছে ' চির নবীন চির প্রণম্য' জীবনের অনতিক্রম্য হাত । তাকে এড়ানোর সাধ্যি কি আমার !
No comments:
Post a Comment