পুরানো সেই দিনের কথা
-এই রূপা!
পরিচিত স্বর শুনে ঘুরে তাকাতেই দেখি গার্গী এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমার আশৈশবের বন্ধু গার্গী; একসাথে বেড়ে উঠেছি আমরা।
গার্গী একটু ইতস্তত করে বলল,
- তোকে একটা কথা বলব, কিছু মনে করবি না তো?
আমি আবাক হয়ে বললাম,
- মনে করব কেন?
গার্গী আবারও খানিক ইতস্তত করে বলে,
- পাড়ার সবাই ব্যাপারটা জানে, অনেকে দেখেছেও… কিন্তু কেউ তোদের বলতে পারছে না।
এবার অজানা আশংকায় আশংকিত হয়ে বলে উঠি,
- সবাই কি জানে, কি দেখেছে?
গার্গী চোখ বড়বড় করে নীচু স্বরে বলে,
- ভূউউত! তোদের বাড়ীর ছাদে ভূত আছে! ঠিক রাত এগারোটা থেকে আলোর ঝলক দেখা যায় তোদের বাড়ীর ছাদে, আলেয়া ভূত!
স্থান কাল ভুলে রাস্তায় দাঁড়িয়েই হেসে বলে উঠি,
-প্রান্তরের পারে তব তিমিরের খেয়া
নীরবে যেতেছে দুলে নিদালি আলেয়া!
গার্গী অবাক হয়ে বলে
-তুই কাব্য করছিস?
এবার খানিক বিরক্ত হয়েই বলি,
-এটা জীবনানন্দের কবিতা... "আলেয়া"!
কে এইসব গুজব ছড়াচ্ছে? খাস কলকাতায় এত আলোর মাঝে আলেয়া? আর আলেয়া কি ভূত নাকি? বিজ্ঞান কিন্তু একেবারেই অন্য কথা বলে… লোককথায় একে ভৌতিক আখ্যা দেওয়া হলেও বিজ্ঞানীরা মনে করেন গাছপালা পচনের ফলে যে মার্শ গ্যাসের সৃষ্টি হয়, তা থেকে আলেয়ার উৎপত্তি। কেউ মনে করেন, বাঁশ বা শুকনো কাঠের ঘর্ষণে যে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয় তা এই মার্শ গ্যাসে আগুন লাগায়। আলেয়াতে থাকা ফসফরাস ডাইহাইড্রাইট গ্যাসটি বায়ুর সংস্পর্শে এলে জ্বলে ওঠে। ফলে অন্যান্য গ্যাসগুলি অর্থাৎ মিথেন এবং ফসফিন একই সাথে নীল শিখাসহ জ্বলতে থাকে। বায়ুপ্রবাহের ফলে জ্বলন্ত গ্যাসটি গতিশীল হয়। আলেয়া কোনো ভৌতিক ব্যাপার নয়।
কেন জানি না, বাড়ী ফেরার পরেও মনটা বড় বিক্ষিপ্ত হয়ে রইল।
আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারে এসি মেশিন ব্যবহারের বিশেষ চল ছিল না। গ্রীষ্মের রাতে বারান্দা কিংবা ছাদের মৃদু-মন্দ বাতাসেই ছিল সে অভাব পরিপূরণের আপ্রাণ চেষ্টা।
তখন রাত প্রায় পৌনে এগারোটা, ভাই ঘরের পোর্টেবল টেলিভিশন-সেটটাকে ছাদে নিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেল,
- দিদি, তাড়াতাড়ি ছাদে আয়, ঠিক রাত এগারোটায় সত্যজিৎ রায় রেট্রোস্পেকটিভস শুরু হয়ে যাবে!
আমার ঠোঁটের কোণায় খেলে যায় মৃদু হাসি।
No comments:
Post a Comment